রাত ২:৩০, মঙ্গলবার, ২রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চট্টগ্রামে একসঙ্গে স্বপ্নের বিসিএস জয় করলেন দুইবোন

হাবীব আরাফাত, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার সৈয়দা ফাতেমা সিদ্দিকা ও সৈয়দা জান্নাতুন নাঈম সিদ্দিকা রানী দুই বোন। সদ্য প্রকাশিত ৪১ তম বিসিএসে একসঙ্গে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তারা। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়াশোনা করেও দুই বোনের এক সঙ্গে স্বপ্নের বিসিএস জয়ে খুশি স্বজনরা। তবে আক্ষেপ দুবোনের সেই স্বপ্নের বীজ বুনে দেওয়া স্কুল শিক্ষক বাবা দেখে যেতে পারেননি কন্যাদের স্বপ্নজয়। তবু তাদের বিশ্বাস সঙ্গেই আছেন বাবা।

ছয় বোনের মধ্যে সবার বড় ফাতেমা। জান্নাতুন নাঈম দ্বিতীয়। ৬ সন্তানের সবাই কন্যা বলে আত্মীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশিরা নানা কথা বললেও মেয়েদের নিয়ে গর্বের শেষ ছিল না বাবার। বাবা মৌলানা সৈয়দ মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন সিদ্দিকি চট্টগ্রামের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। স্কুলে শিক্ষকতা করে পাওয়া অর্থ দিয়ে নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে গেছেন একসঙ্গে। মেয়েদের বড় বড় স্বপ্নের কথা বলতেন আলতাফ হোসেন, সেই স্বপ্ন রাঙিয়ে দিত ৬ কন্যাকে।

চাকরীর সুবাদে মেয়েরা ছোট থাকা অবস্থাতেই নিজ এলাকা ফটিকছড়ি উপেজেলার নাজিরহাট পৌরসভা ছাড়েন বাবা। পুরো পরিবার নিয়ে ছুটেছেন এক এলাকা থেকে অন্য এলাকা। তবে তাদের পড়াশোয় এতটুকু ক্ষতি হতে দেননি।

মেয়েরা বড় হতে থাকলে পড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনরা তাদের জন্য সম্বন্ধ নিয়ে আসতে শুরু করেন। কিন্ত নিজের অবস্থান থেকে একচুলও নড়েননি তিনি। তার ভাষ্য, ‘মেয়েরা পড়াশোনা শিখবে, মানুষের মত মানুষ হবে।’ এ নিয়েও আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশীদের আপত্তির শেষ ছিল না। সেসব কখনো গায়ে মাখেননি মৌলানা আলতাফ। বরং মেয়েরা যেন কারো কথায় কখনো স্বপ্নচ্যুত না হয় সেই চেষ্টাই করতেন।

২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আলতাফ হোসেন মারা যান। তবে তার স্বপ্ন আর সংগ্রাম বৃথা যেতে দেননি তার কন্যারা। আলতাফ হোসেনের দুই মেয়ে সৈয়দা ফাতেমা সিদ্দিকা ও সৈয়দা জান্নাতুন নাঈম রানী ৪১ তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাদের ছোট দুই বোন সৈয়দা ইসরাত জাহান সিদ্দিকা ও সৈয়দা তানজিনা সিদ্দিকা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। পাশাপাশি বিসিএসের জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ছোট দুই বোনের মধ্যে সৈয়দা রাহিমা সিদ্দিকা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে শেষ বর্ষে পড়ছেন। সবচেয়ে ছোট সৈয়দা নিশাত সিদ্দিকা পড়ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে।

জান্নাতুন নাঈম অবশ্য ৪০ তম বিসিএসেই ক্যাডার হিসেবে (শিক্ষা) সুপারিশপ্রাপ্ত হন। সেবারই প্রথম বিসিএসে অংশগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে ২০১৫ সালে স্নাতক ও ২০১৬ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি।

৪১ তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে ফের সুপারিশপ্রপ্ত হন জান্নাতুন, এবার তার সঙ্গে সুপারিশপ্রাপ্ত হন বড় বোন ফাতেমা সিদ্দিকাও। তবে ফাতেমা ৪১ তম বিসিএসেই প্রথমবার অংশগ্রহণ করেন। সেই হিসেবে দুবোনই প্রথমবার অংশগ্রহণ করেই সুপারিশপ্রাপ্ত হন। ফাতেমা সিদ্দিকার পড়াশোনা চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজে। ২০১৪ সালে বাংলায় স্নাতক ও পরের বছর একই কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি।

জান্নাতুন নাঈম বলেন, ‘আমরা ৬ সন্তান একসঙ্গে পড়াশোনা করছি, আর্থিক টানাপোড়ন থাকলেও কখনো বুঝতে দেননি বাবা। সবার আগে আমাদের পড়াশোনাকে আগ্রাধিকার দিতেন। আমরা প্রথম তিনবোন ২০১৮ সালে প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলাম, তখন বাবা অনেক খুশি হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে আমার ৪০ তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট ঘোষণার ১০ দিন আগে তিনি আমাদের ছেড়ে যান। ওনি আমাদের সফলতা দেখে যেতে পারেন নি। তবে আমাদের বিশ্বাস, ওনি আমদের সঙ্গেই আছেন।’

ফাতেমা সিদ্দিকা বলেন, “আব্বু-আম্মু দুজনই পড়াশোনা জানা মানুষ হওয়ায় আমরা শিক্ষার পরিবেশটা পেয়েছি। পরিবারে আমাদের পড়াশোনাটাই সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি পেত। বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথা বলতেন। আব্বুকে এসে বলতেন যে, ‘আপনারা তো বয়স্ক হয়ে গেছেন, মেয়েদের বিয়ে দেন। মেয়েদের কে দেখবে?’ আমার বাবা বলতেন, ‘আমার মেয়েরা মানুষের মত মানুষ হবে, তারা নিজেরাই নিজেদের দেখবে, দেশ ও দশের জন্য কাজ করবে।”

মেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল আলতাফ হোসেনের একমাত্র স্বপ্ন ছিল বলে জানান তার স্ত্রী সৈয়দা কুলসুমা আকতার। তিনি বলেন, ‘তখন কীভাবে যে মেয়েদের নিয়ে এত কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছি এখন পেছনে তাকালে অবাক লাগে। তাদের বাবার একমাত্র স্বপ্নই ছিল মেয়েদের মানুষের মত মানুষ করা। রক্ষণশীল পরিবারে মেয়েদের পড়াশোনা করতে দেয়া হয় না বলে ধারণা অনেকের। কিন্তু ওদের বাবার মৌলানা ছিলেন, ওনি তো সবকিছু জানতেন। তিনি বলতেন , ‘শালীনতার মধ্যে থেকে জ্ঞানার্জনে কোনো বাঁধা নেই।’ আমার মেয়েরাও অনেক মেধাবী ছিল, তারা সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় বৃত্তি পেত।’

সৈয়দা কুলসুমা বলেন, ‘এক সময় আমাদের মেয়েদের নিয়ে যারা নেতিবাচক কথা বলতো, তারা এখন আমার মেয়েদের নিয়ে গর্ব করে। তাদের ধারণ করে। এখন অনেকেই বিশ্বাস করে যে মেয়েরা চাইলেই অনেক কিছু পারে।’

মৌলানা আলতাফ হোসেনকে উদ্ধৃতি করে তিনি বলেন, “ওনি বলতেন, ‘আমার এই ছয়জন মেয়ে বলে কী হয়েছে? তারা মানুষ হলে ছেলেদের চেয়েও বেশি কিছু। আমার ছয়জন মেয়ে নয়, তারা আমার রত্ন।’”

স্থানীয় কাউন্সিলর মো. আমান ‍উল্লাহ বলেন, ‘ওনি একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। ওনার কোনো ছেল ছিলনা, মেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করেছেন। আগে তার প্রথম চার মেয়ে প্রাইমারীর শিক্ষক ছিলেন, এখন বড় দুজন বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। ছোটদুজনও ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতেছে। তারা আমাদের এলাকার গৌরব। নারী শিক্ষায় একটা দৃষ্টান্ত এটা।’

আজকের সারাদেশ/১০আগস্ট/এএইচ

সর্বশেষ সংবাদ

কবিতা: স্বাধীনতা।

ভূমি, কার্গো দখল ও ঘর ভাংচুরের ঘটনায় কবিরহাট থানায় মামলা

চবিতে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের ‘মুক্ত সংলাপ’ প্রত্যাখান শিক্ষার্থীদের, ষড়যন্ত্র না করতে দিল হুঁশিয়ারি

১৫ বছর পর মাতৃভূমিতে যুবদল নেতা হাসান নূরী

চবি উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক শামীম অথবা ড. আতিয়ারকে চান শিক্ষার্থীরা

ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হওয়ার দায় নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইলেন পলক

কোপা আমেরিকার সেরা একাদশে ৫ জনই আর্জেন্টিনার, ব্রাজিলের এক

গুলিবিদ্ধ কিশোরকে রিকশায় তুলতে গিয়ে দেখলেন নিজেরই সন্তান

নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করবে চবি কর্তৃপক্ষ

১২ দিন পর স্বল্প পরিসরে ট্রেন সার্ভিস চালু