হাবীব আরাফাত, চট্টগ্রাম
“আঁই মরি গেইগুই আবাজি (আমি মরে গেছি বাবাজি), কূললান লইগেইগো দইরগে অবজি, আরারে বাঁচা (আশ্রয়স্থলটা নিয়ে গেছে নদী আমাদের বাঁচাও)! আঁরারে যদি রক্ষা গরো, আঁই দোয়া গরির, আল্লাহ’র কাছে পাইবে (আমি দোয়া করতেছি, আমাদের রক্ষা করলে আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাবে)। বাজি আল, আঁরারে দয়া গরি বাঁচঅ (বাবারা আমাদের দয়া করে বাঁচাও)। ও বাপ-ভাইঅল (বাবা-ভাইয়েরা), আঁরারতে আর কোনো আশ্রয় নাই যাবেইল্লায় (যাওয়ার জন্য)। আরাঁরে যদি বাঁচাইত পারো আল্লাহর কাছে সওয়াব পাইবা।” শনিবার বিকেলে পানি উন্নয়ন বোর্ডর কর্মকর্তাদের সামনে কেঁদে কেঁদে এভাবেই আকুতি জানাচ্ছিলেন সাতকানিয়ার চরতি ইউনিয়নের দক্ষিণ ব্রাহ্মণ ডেঙ্গা গ্রামের সত্তরোর্ধ নূর হোসেন মিয়া।
দক্ষিণ চট্টগ্রামে ভয়াবহ বন্যার পর সাঙ্গু নদীর ভাঙন কেড়ে নিয়েছে বৃদ্ধ নূর হোসেনের শেষ আশ্রয়স্থল। নদী ভাঙ্গনে ঘর চলে যাওয়ায় ৩ মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন তিনি। শুধু নূর হোসেন নন, বন্যার পর গত দুই দিনে দক্ষিণ ব্রাহ্মণ ডেঙ্গা গ্রামের অন্তত ১০ টি পরিবারের আশ্রয়স্থল কেড়ে নিয়েছে সাঙ্গু। ভাঙ্গনের কবলে আছে আরো অন্তত ৫০ পরিবার। প্রতিবছর ওই গ্রামে সাঙ্গুর ভাঙনে ৫ থেকে ১০ টি পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে বলে জানান স্থানীয়রা। নদী ভাঙন রুখতে বার বার পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর ধারস্থ হয়েও কোনো প্রতিকার পাননি তারা।
নূর হোসেন মিয়া জানান, বন্যায় সবার বাড়ি-ঘর ডুবে গেছে। সেসময় এলাকার অপেক্ষাকৃত উঁচু বাড়িগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বন্যায় বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে গেলেও অন্তত ভূমিটা থেকে যায়। কিন্তু ভাঙনে এক ইঞ্চি ভূমিও অবশিষ্ট নেই আর।
স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুমন দাশের ত্রিশ বছরের পুরনো ঠিকানা মাত্র ত্রিশ মিনিটে বিলীন হয়ে গেছে সাঙ্গুতে। তিনি বলেন, ’৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময় আমাদের বাড়ি ভেঙ্গে গিয়েছিল। এরপর নতুন করে বাড়ি তৈরি করা হয়। তখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। এখন আমার বয়স ৪২ বছর, আজ ৩৩ বছর পর আবার ঘর ভেঙ্গে নিয়ে গেছে। এখন কোথায় গিয়ে ঘর বাঁধব, কোথায় সমাজ থাকবে, কোথায় পাড়া থাকবে কিছুই জানি না। এখন আমরা রোহিঙ্গার মত আশ্রয়হীন হয়ে গেছি। ছোটছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোথায় থাকব- সেটা ভাগবান জানে।’
তিনি অভিযোগ করেন , “নদী ভাঙন হলে সব জায়গায় ব্লক এবং জিও ব্যাগ দিচ্ছে। কিন্তু আমরা গত পাঁচ বছর ধরে জিও ব্যাগ ও ব্লকের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ও সচিবালয়ে গিয়েছি, সবাই ‘হবে হবে’ আশ্বাস দেয়, কিন্তু এখনো হয়নাই।”
‘আমি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, আমি মাননীয় সংসদ সদস্যকে বলেছি, পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলেছি, উপজেলা চেয়ারম্যানকে বলেছি, বিভিন্ন জায়গায় আমরা দরখাস্ত দিয়েছি। আজ পর্যন্ত আমাদের এটার কোনো সুরহা হয়নি।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী সাম্প্রতিক বন্যায় সাঙ্গু নদীর ৩০ থেকে ৪০ টি অংশে ভাঙন শুরু হচ্ছে। এর মধ্যে দক্ষিণ বাহ্মণডেঙ্গাসহ অন্তত তিনটি অংশে ভাঙনের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
এসব অংশে সব মিলিয়ে ৩০ টিরও বেশি ঘর বিলীন হয়েছে নদীগর্ভে। ভাঙনের কবলে রয়েছে আরো শতাধিক। নদীতে বিলীন হওয়ার আগে ঘর ভেঙে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দূরবর্তী কোথাও নিয়ে রক্ষার চেষ্টা করছেন ভাঙনের কবলে থাকা অনেকেই।
নদী ভাঙ্গনের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (চট্টগ্রাম) শওকত ইবনে শহীদ বলেন, ‘সাঙ্গ নদীতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যে ভাঙন ছিল তা নিয়ে ৬ কিলোমিটারের তীর প্রতিরক্ষার একটা প্রকল্প চলমান রয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ ব্রাহ্মণ ডেঙ্গার ভাঙনটা শুরু হয়েছে ২০২‘১ সালে। তাই চাইলেই এটা ওই প্রকল্পে যুক্ত করা যাচ্ছে না। মূলত তীর প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ব্লক বসানোটা খুবই ব্যয়বহুল, আর্থিক সংকটের কারণে যা সবসময় করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি, একটা প্রকল্প আসতেছে, ওই প্রকল্পের আওতায় ৭ থেকে ৮ টা স্পটে ব্লক বসানো যাবে। আপাতত আমরা দক্ষিণ ব্রাহ্মণ ডেঙ্গা জরুরী ঘোষণা করেছি আমরা। সেখানে জিও ব্যাগ দিয়ে আপাতত অস্থায়ী প্রতিরক্ষা কাজ করা হবে।’
আজকের সারাদেশ/১৩আগস্ট/এএইচ
