হাবীব আরাফাত, চট্টগ্রাম
‘কই গেলারে আঁরে ফেলাই? আল্লাহ, তুমি কী করলা আমারে? আমারে তো শেষ করছে! আমার তো সব শেষ! সব শেষ, শেষ সব আমার!’ পাহাড় ধসে ঘুমন্ত স্বামী ও সাত মাসের কন্যাকে হারিয়ে এভাবেই আহাজারী করছিলেন শরীফা বেগম। একটু পর পর মৃত স্বামীর উদ্দেশ্যে বলছিলেন, ‘কই গেলারে আঁরে ফেলাই? কোথায় রাখি গেলা আমারে?’ রোববার দুপুরে নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনের পেছনের পাহাড়ে আই ডব্লিউ কলোনিতে গিয়ে দেখা গেল শরীফার এমন আহাজারী। তার আহাজারী ছুঁয়ে যায় আশেপাশে সবাইকে। কান্নায় ভেঙে পড়েন তার স্বজনরাও।
শনিবার রাতেও সব ঠিক ছিল শরীফার। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে স্বামী ও দুই কন্যাকে নিয়ে ঘুমিয়েছিলেন তিনি। রোববার ভোর ছয়টার দিকে হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করেন মাটির নিচে। ঘটনা আঁচ করতে পেরে পাশে থাকা তার সাত মাসের কন্যা বিবি জান্নাতকে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পযন্ত ব্যর্থ হন তিনি। প্রতিবেশীরা যতক্ষণে তাদের উদ্ধার করে তাদের হাসপাতালে নেন, ততক্ষণে প্রাণ হারায় বিবি জান্নাত। চিরতরে উড়াল দেন স্বামী সোহেলও। শরীফা নিজে ও তার ষষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া বড় কন্যা বিবি কুলসুমা আক্তার মিম প্রাণে বেঁচে গেলেও আহত হয়েছেন মাটিচাপায়। তবে শরীফার কাছে সেই ক্ষতের চেয়ে স্বামী-সন্তান হারানোর ক্ষত ঢের গভীর।
পাহাড় ধসের শব্দ শুনে শরীফা ও তার স্বজনদের উদ্ধার করেন জা সাজিয়া আক্তার সাজু। নিউজবাংলা/দৈনিক বাংলাকে তিনি বলেন, ‘বিকট শব্দ শুনে দৌড়ে উঠে দেখি ওদের ঘরের দরজা বন্ধ। তাদের অনেক ডাকার পরও দেখি দরজা খুলে না। সাবাইকে ডেকে তিনজনে ভেঙেছি দরজা, ভেঙে দেখি ওরা সবাই মাটির নিচে।’
‘তিনজনের পা দেখা যাচ্ছিল, ছোটটার কিছুই দেখা যায়নি। আমরা টেনে মিমকে বের করছি। সবাইকে ডাকতেছি, কেউ আসেনি।’

সাজিয়ার বিয়ে হয়েছে ১৫ বছর। বিয়ের পর থেকেই তিনি পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করে আসছেন। স্বামী-স্বজনদের রেলওয়েতে কর্মচারী হিসেবে চাকরীর সুবাদের আরো অগে থেকেই ওই এলাকায় বসবাস করে আসছেন তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
ধসের ওই স্থানে কয়েকদিন ধরে পাহাড় কেটে দেয়াল তৈরি করতেছে খালেদ নামের রেলওয়ের এক কর্মচারী। সাজিয়াসহ স্থানীয়দের দাবি পাহাড় কেটে ওই দেয়াল তৈরির কারণেই ঘটে পাহাড় ধসে এই প্রাণহানির ঘটনা। সাজিয়া বলেন, “৮ থেকে ১০ দিন ধরে খালেদ মাটি কেটে দেয়াল তুলতেছিল। গতকালও মাটি কাটছে। আমরা জিজ্ঞেস করছি, ‘কাকা, দেয়াল কেন তুলেন? আমাদের মারার জন্য নাকি?’ সে বলে, ‘তোরা মরবি না, তোদের বাঁচানোর জন্যই দেয়াল তুলে দিচ্ছি।’ অনেকেই তাকে গালি দিছে, তাকে বলছে ভাঙলে তার বিচার হবে। এখন বিচার হয়ে কী হবে?’
প্রাণহানির পর প্রশাসনের তোড়জোড়:
রোববার ভোরে পাহাড় ধসে প্রাণহানির পর তোড়জোড় করেছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। পাহাড় ধসে প্রাণহানির খবরে তড়িঘড়ি করে ষোলশহর রেলস্টেশন এলাকায় পাহাড়ে অবৈধভবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করে জেলা প্রশাসন। তবে পাহাড় ধসের পর ওই এলাকার ঠিক কী পরিমাণ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি জেলা ত্রান ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সাইফুল্লাহ মজুমদার।
২৬ পাহাড়ে লক্ষাধিক অবৈধ বসবাসকারি:
ষোলশহরে পাহাড় ধসে নিহতের স্বজনরা রেলওয়েতে চাকরির সুবাদে ওই পাহাড়ে বসবাসের কথা জানালেও মূলত পাহাড় দখল করে অবৈধভাবে বসতি গড়েছেন তারা। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী তাদের মত বর্তমানে নগরীর ২৬ টি পাহাড়ে ৬ হাজার ৫৫৮ টি পরিবার অবৈধভাবে বসবাস করছে। তবে পরিবেশকর্মীদের দাবি পাহাড়ে বসবাসকারীদের প্রকৃত সংখ্যা তার কয়েকগুণ। জীবণের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ে বসবাস করছে লক্ষাধিক মানুষ।
পাহাড় বাঁচাতে তিন উদ্যোগ চান পরিবেশ কর্মীরা:
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীর ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ পাহাড় নিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বর্তমানে যে কয়টা পাহাড় বেঁচে আছে সেসব রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের প্রতি তিনটি উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আলিউর রহমান। এই পরিবেশ সংগঠক বলেন, ‘পাহাড় রক্ষায় সংশ্লিষ্টরা তিনটি উদ্যোগ নিতে পারে। প্রথমত পাহাড় খালী না রেখে, পরীক্ষা করে সেসব কীভাবে কাজে লাগানো যায় তার উপায় বের করা। দ্বিতীয়ত ব্যাক্তিমালিকাধীন পাহাড়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট রিপোর্ট দেওয়া যে, তারা এটার বাইরে যেতে পারবে না। তৃতীয়ত এজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুশিসসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের লোক নিয়ে একটা স্ট্রাইক ফোর্স গঠন করা। এই টিমটা সবসময় পাহাড় দেখভাল নিয়ে কাজ করবে।’
আজকের সারাদেশ/২৭আগস্ট/এএইচ