হাবীব আরাফাত, চট্টগ্রাম
আদুরে আর নাদুস নুদুস চেহেরার ছোট্ট ইয়াসিন আরাফাত। শালদুধের পাশাপাশি কৌটাজাত পাউডার দুধও তাকে খাওয়াতেন মা নাসরিন আক্তার। আরাফাতের জন্য কেনা কৌটার দুধ শেষ হয়ে আসায় নতুন আরেকটি কৌটা কেনার কথা চিন্তা করছিরেন মা। তবে শেষ হয়ে আসা সেই কৌটা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই চিরতরে হারিয়ে গেছে ছোট্ট আরাফাত। সেই কৌটা দেখিয়ে মা নাসরিন আক্তার বলেন, ‘এটা শেষ হয়ে এসেছিল, তাই আম্মুকে বলেছিলাম ওর (আরাফাত) জন্য নতুন আরেক কৌটা পাউডার দুধ কিনতে। কিন্তু নতুন কিনতে হয়সি, এখনো আগের কৌটার অর্ধেক দুধ রয়ে গেছে। কিন্তু আমার ছেলেটা নেই।’
সপ্তাহ দুয়েক আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে তাকে নিয়ে বাবার বাসায় বেড়াতে আসেন মা। নাসরিনের বাবার বাসা চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রবাদে রঙ্গিপাড়া এলাকার একটি ভবনের নিচতলায়। সেই বাসার সামনে ৪ থেকে ৫ ফিট প্রস্থের নালা। নালার কিছু অংশে সিমেন্টের স্ল্যাব থাকলেও অধিকাংশই উন্মুক্ত। গেল কয়েক বছরে এই উন্মুক্ত নালায় পড়ে আহত হয়েছেন ওই এলাকার অন্তত তিনজন। মূলত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মহেশখালের সংযোগ নালা এটি। কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ এই নালার কিছু কিছু অংশে স্ল্যাভ থাকলেও অধিকাংশই উন্মুক্ত।
রোবাবর বিকেল চারটার দিকে ওই বাসা থেকে নিখোঁজ হয় আরাফাত। বাসার সামনে উন্মুক্ত নালার মত মরণফাঁদ থাকায় সাধারণত শিশুদের নিরাপত্তার জন্য ভবনের প্রধান ফটক বন্ধ থাকে। বন্ধ থাক নাসরিনের বাবার বাসার দরজাও। কিন্তু রোববার দুর্ভাগ্যক্রমে বাসা ও ভবনের দরজা খোলা ছিল। এতে নাসরিনসহ সবার সন্দেহ হয় নালায় পড়েছে আরাফাত।
খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস রোববার বিকেল পাঁচটা থেকে ওই নালায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেও ব্যর্থ হয়। পরদিন আবর শুর হয় উদ্ধার অভিযান। তাতেও মিলছিলনা ছোট্ট আরাফাতের খোঁজ। এতে শিশুাট আদৌ নালায় পড়েছে কিনা তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়। তবে সোমবার সকালে ওই নালায় ময়লা পরিষ্কারের সময় তার মরদেহ পায় সিটি কর্পোরেশনের এক পরিচ্ছেন্নতা কর্মী। নালার স্ল্যাভের নিচে ভবনের প্রধান ফটকের ৫ থেকে ৭ ফুটের মধ্যেই পাওয়া যায় আরাফাতের মরদেহ।
ছোট্ট আরাফাতের এমন মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে পুরো এলাকায়। সোমবার দুপুরে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির সামনে বিষন্ন দাড়িয়ে আছে সেখানকার ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী কয়েকজন শিশু। মাঝে মধ্যেই ছোট্ট আরাফাতকে সঙ্গে নিয়ে খেলতো তারা। ভবনের নিচতলায় আরাফাতের নানার বাসায় প্রবেশ করতেই দেখা মিলল তার মায়ের। দরজার সামনেই নির্লিপ্ত বসে আছেন তিনি। যেন কী হয়েছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দুপুরের পর ওকে ভাত খাইয়ে আমি খাচ্ছিলাম। তখন আমার ওড়না ধরে ছিল, পরে আমার মা ওরে একটা জগে পানি দিছে, ওখানে পানি ফেলতেছিল। দরজাটা খোলা ছিল। আমি খাওয়ার সময় মাত্র এক নালা খাইছি, ও বাইরে চলে যাচ্ছে। আমার মা কয় ওরে আনতাম, তখন আমি ভাত ফেলে পুতরে (ছেলেকে) আনতে গেছি। এক-দুই মিনিটের মধ্যে আর পাই নাই।’

‘ভাত যখন মাখতেছি, কান্না করতেছে ওকে দেওয়ার জন্য। মানে আমি না খাওয়াইাম ও খাবে। তখন আমার আম্মুর কথা শুনে ভাতগুলো মেখে ওরে দিছি। পরে ভাজি দিয়ে দিছি, ওভাবেই খাইছে।’
শুরুতেই নালায় পড়েছে বলে সন্দেহ করেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন ‘তখন আমি সন্দেহ করছি নালায় পড়ছে। সবাইকে নালায় নামাইছি। ফায়ার সার্ভিসকে কল দিতে বলছি।’
সিটি কর্পোরেশনের উন্মুক্ত নালায় একমাত্র ছেলেকে হারালেও কাউকে দোষ দিতে চাননা নাসরিন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করতে চাইনা। যদি কেই দায়ী হয় আল্লাহ বিচার করবে’
নাসরিনের বোন পাখি আক্তার বলেন , ‘আগে স্বামী সন্তানসহ নাসরিনও একই বাসায় থাকতেন । তবে গেল কোরবানির ঈদে স্থায়ীভবে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্ম,ণবাড়িয়ার নবীনগরে চলে যায় তারা। নাসরিনের স্বামী মাঝে মধ্যে গাড়ি চালক হিসেবে কাজ করেন, আবার মাঝে মধ্যে রাজমিস্ত্রী হিসেবেও কাজ করেন। তবে কিছুদিনের মধ্যে বিদেম যাওয়ার কথা তার। সপ্তাহ দুয়েক আগে একমাত্র সন্তান ইয়াসিন আরাফাতকে নিয়ে বেড়াতে আসে নাসরিন।’
চট্টগ্রামে উন্মুক্ত নালায় এমন প্রাণহানির ঘটনা নতুন নয়। এর আগে গত ৭ আগস্ট চট্টগ্রামের নন্দীরহাট এলাকায় জলাবদ্ধ সড়কের পাশের ড্রেনে পড়ে মৃগি রোগাক্রান্ত এক কলেজছাত্রীর মৃত্যু হয়। তারও আগে ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট নগরীর মুরাদপুরে জলাবদ্ধ সড়কের পাশের উন্মুক্ত নালায় তলিয়ে নিখোঁজ হন সবজি ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ। এখনও তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এর প্রায় এক মাস পর ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে নগরের আগ্রাবাদ এলাকায় বাসায় ফেরার পথে নালায় পড়ে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া। একই বছর নালায় পড়ে নগরীর ষোলশহর এলাকায় এক শিশু ও ২ নম্বর গেইট এলাকায় সিএনজি অটোরিকশাসহ নালায় পড়ে দুই নারী নিহত হন।
এসব ঘটনার পর নগরীর সবগুলো উন্মুক্ত নালায় স্ল্যাব বসানোর ঘোষণা দেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। তবে সেই ঘোষণার দুই বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়নি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ রেজাউল করিমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
আজকের সারাদেশ/২৮আগস্ট/এএইচ