আজকের সারাদেশ প্রতিবেদন:
সকালে যে মেয়েটাকে রেখে নাজমা আক্তার বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন কর্মস্থলের উদ্দেশে, তারই নিথর দেহটা পড়ে আছে লাশ কাটা ঘরে। একটু পরেই শুরু হবে মময়নাতদন্ত। মাত্র কয়েকঘণ্টার ব্যবধানে ঘরদোর রাঙিয়ে রাখা বড় আদরের মেয়েটা এমন নির্মমতার শিকার হবে, কীভাবে মানবেন এই মা। লাশকাটা ঘরের বাইরে বসে তাই অবিশ্বাসের সুরে বিলাপ করছিলেন এই নারী , ‘মা তুই কি সত্যি সত্যি নেই! মা আমার সঙ্গে একটু কথা বল না।’
রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের চত্বরে এভাবেই পাওয়া গেল সদ্য মেয়ে হারা মা নাজমাকে। তাঁর নাড়িছেঁড়া ধন তানহা আক্তার মারিয়া নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছে। রোববার বেলা ১১ টার দিকে পুলিশ তানহার মরদেহ উদ্ধার করে। চান্দার বাপের বাড়ির এলাকার একটি নূরানী মাদরাসায় পড়াশোনা করত সে৷
এই ঘটনায় ২২ বছর বয়সী রাকিবুল ইসলাম মুন্না নামের এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ। কক্সবাজারের কক্সশাহী টিকা পল্লীর প্রয়াত ইউসুফের ছেলে। তবে সেও চান্দার বাপের বাড়ির একই এলাকায় বসবাস করত।
তানহার বাবা মো. বাকের পেশায় রিকশাচালক ও মা পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কাজের সুবাদে দুজনেই প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যান। তানহা তাই একাই বাসায় থাকত। রোববার সকালে তানহার বাবা-মা কর্মস্থলে যাওয়ার পর ওই বাসার দরজা বন্ধ দেখে এক প্রতিবেশী নারী ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখেন। বিষয়টি টের পেয়ে মুন্না কৌশলে ঘর থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যেতে দেখে। সন্দেহ হলে ওই নারী ঘরের ভেতরে যান। এ সময় বিছানায় তানহাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মৃত পড়ে থাকতে দেখে তিনি অন্য প্রতিবেশীদের খবর দেন।
মেয়ের লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে কারখানা থেকে বাসায় ছুটে আসেন নাজমা আক্তার। পরে ময়নাতদন্তের জন্য তানহার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় চমেক হাসপাতালে। মেয়ের মরদেহের পিছু পিছু হাসপাতালে ছোটেন নাজমাও।
রোববার বিকেলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে দেখা যায়, সবসময়ের মতো সেখানে লেগে আছে থিক থিকে ভিড়। রোগী আর স্বজনদের আনাগোণা, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। এর মধ্যেই ফুটপাতে বসে বিলাপ করছিলেন নাজমা। আশপাশের মানুষ এসে তাঁকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই যেন শান্ত হতে পারছিলেন না এই মা।
তানহা ছিল মা-বাবার একমাত্র সন্তান। অভাবের সংসারে ওই যেন সবটুকু আলো। সেই মেয়েটাই এভাবে চোখের সামনে থেকে সরে অতীত হয়ে যাবে ভাবতেই পারছেন না নাজমা।
তানহাকে আদর করে ‘লালচান পাখি’ বলে ডাকতেন নাজমা। সেই নাম ধরে ডেকে এই নারী বলছিলেন, ‘কত কষ্ট করে তোরে বড় করলাম। তোকে এত কষ্ট করে মারল। আমি কীভাবে সইব।’
তানহাকে হত্যার অভিযোগে আটক তরুণের সর্বোচ্চ শাস্তি চান নাজমা। ওই তরুণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ। গরীব মানুষের দিকে কেন তোর নজর গেল।’
ময়নাতদন্ত শেষে মাকে তানহার মরদেহ বুঝিয়ে দেয় পুলিশ। দেহটে বুকে জড়িয়ে নাজমা বলতে থাকেন, ‘মা তোকে বুকে জড়িয়ে প্রতিদিন ঘুমাতাম। আজ থেকে আমি কাকে বুকে জড়িয়ে ধরব মা।’
সন্ধ্যা নামার একটু আগে তানহার দেহ নিয়ে গাড়িতে করে বাসার দিকে ছুটতে থাকেন স্বজনেরা। ছোট্ট মেয়ের দেহের পাশে বসে আনমনে মেয়েকে ঘিরে থাকা নানা স্মৃতি আওড়াতে থাকেন মা। গাড়ি সড়কে মিলিয়ে যাওয়ার আগেও কানে আসে সেই বিলাপ, ‘মা আমার সঙ্গে একটু কথা বল না!’
আজকের সারাদেশ/১৭সেপ্টেম্বর/এএইচ