আজকের সারাদেশ ডেস্ক:
লিবিয়ার ডেরনা শহরে যেতে এখন আগের চেয়ে দ্বিগুণ সময় লাগছে। বেনগাজি থেকে সড়ক ধরে যেতে যেতে দেখা যায় দুপাশের জমিগুলো মরিচা ধরা লালচে পানিতে তলিয়ে গেছে। কাছে গেলেই দেখা যায় যানবাহনের গতি ধীর। ভূমি থেকে উপড়ে গেছে তারবাহী বিদ্যুতের পিলারগুলো। সড়কের এখানে-সেখানে তৈরি হওয়া গর্তে পড়ে বেহাল দশা হয়ে পড়ছে যানবাহনের। ভূমধ্যসাগরঘেঁষা এ শহর যেন পরিণত হয়েছে সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরীতে। ডেরনার কাছেই একটি সেতু বন্যার পানিতে পুরোপুরি ভেসে গেছে। সেখানে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকজন ছবি তুলছে।
কাছেই সেনাসদস্যদের দেখা গেল প্রতিটি গাড়ির চালক ও যাত্রীকে মাস্ক দিচ্ছেন। মাস্ক পরেই বিকল্প পথে যানবাহন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন চালকরা। কিছুদূর গেলেই বোঝা যায় এর কারণ কী। শহরের বিভিন্ন জায়গায় মরদেহের যে গন্ধ তার বর্ণনা দেয়া প্রায় অসম্ভব। নিশ্বাস নিলে কিছুটা স্যুয়ারেজের গন্ধ মনে হলেও বাকিটা কেমন তা বর্ণনা করা কষ্টসাধ্য।
ভাঙা কাঠের টুকরো, ভেসে যাওয়া ভাঙা গাড়ি, টায়ারসহ নানা কিছু। সব মিলেমিশে একাকার হয়ে ভেসে আছে পানিতে। ছবি ও ভিডিও দেখলে হতভম্ব হবেন যে কেউ। তবে সেগুলো দেখলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। পানির ধ্বংস করার ক্ষমতা ছিল অবিশ্বাস্য।
খেলনার মতো যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে গাড়ি। মসজিদের দেয়াল উড়ে গেছে। আবার কোথাওবা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মোটা কংক্রিটের দেয়ালের কোনো চিহ্ন নেই। শিকড় বেরিয়ে এসেছে গাছপালার।
এখানে শুধু কয়েক হাজার মানুষ পানিতে ভেসে যায়নি। ভেসে গেছে তাদের ঘরবাড়ি, তাদের জীবন। মানবতা যেন ধুয়ে-মুছে গেছে শহরের এ অংশ থেকে। যারা বেঁচে আছেন তাদের জীবন পাল্টে গেছে। এখন শুধু দুঃখ আর ক্ষোভ।
ফারিস গাসার তার পরিবারের পাঁচজনকে হারিয়েছেন। ‘আমাদেরকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছিল,’ বলেই কাঁদছিলেন তিনি। ‘তাদের বলা উচিত ছিল যে, ঝড় আসছে আর বাঁধটি নাজুক হয়ে পড়েছে। কয়েকশ বছরের পুরোনো ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। এটা পুরোপুরি রাজনীতি। পশ্চিমে একটি সরকার, পূর্বে আরেকটি সরকার। এটাই আমাদের বড় সমস্যা।’
ফারিস গাসার নিহত স্বজনদের মধ্য একজন তার দশ মাস বয়সি কন্যা।
আমাকে ছবি দেখানোর জন্য তিনি মোবাইল ফোন আনলেন। প্রথমে জীবিত। এরপর মৃতদেহ। কম্বলে মোড়ানো ছিল। মুখমণ্ডল দেখেই পরিস্থিতি আঁচ করা যায়।
পূর্বাঞ্চলীয় প্রধানমন্ত্রী ওসামা হামাদকে বিবিসির প্রতিনিধি জিজ্ঞেস করেন, মানুষকে সুরক্ষিত রাখার জন্যই তো বাঁধ করা হয়েছিল তারপরেও এমনটা কীভাবে ঘটল। জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা ছিল খুবই শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। বাঁধের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। এটাই প্রকৃতি এবং এটাই আল্লাহ।’
লিবিয়ার ডেরনা শহরে বন্যায় এখনো পর্যন্ত পাঁচ হাজার তিনশর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসনের একজন মন্ত্রী হিশাম চোকিওয়াত বলছেন, ‘সাগরে ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে লাশের পর লাশ’। আবার বহু মানুষ লাশের ব্যাগ জড়িয়ে ত্রাণ সহায়তার জন্য আকুতি জানাচ্ছে। নিহতদের অনেককে গণকবরে দাফন করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েল রোববার আঘাত হানলে শহরের একটি বাঁধ ফেটে যাওয়ার পর ডেরনা শহর বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। চোকিওয়াত বলছেন, ডেরনা শহরের কিছু এলাকা একেবারেই হাওয়া হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘কল্পনা করুন একটি আবাসিক এলাকা পুরো ধ্বংস হয়ে গেছে। আপনি এখন দেখতেই পারছেন না। এটা আর নেই।’
সেখানে সাগরে ভেসে যাওয়া মানুষকে উদ্ধার করতে রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে উদ্ধারকারী দলগুলোকে। ডেরনা শহরের দুটি বাঁধ ও চারটি সেতু ধসে গেছে।
রেডক্রিসেন্ট বলছে, হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ আছে এবং মৃতের সংখ্যাও আরও বাড়তে পারে। উদ্ধারকর্মীরা ভবনগুলোর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে জীবিত মানুষের সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।
কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জাতিসংঘ অভিবাসন সংস্থা বা আইওএম বলেছে, শহরটিতে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অন্তত ত্রিশ হাজার মানুষ। হাসপাতাল আর মর্গগুলোতে পড়ে আছে বহু মানুষের মৃতদেহ। ডেরনার কাছে একটি হাসপাতালে কর্মরত লিবিয়ার চিকিৎসক নাজিম তারহনি বলছেন, আরও সহায়তা দরকার।
‘হাসপাতালে আমার অনেক বন্ধু আছে যারা তাদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছে। তারা সবকিছু হারিয়েছে,’ তিনি বিবিসি রেডিও ফোরকে বলছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমার এমন লোকজন দরকার, যারা পরিস্থিতি বুঝতে পারবেন। প্রয়োজনীয় সহায়তা দরকার। এমন কুকুর প্রয়োজন যারা ঘ্রাণ শুঁকে মানুষ বের করে নিয়ে আসতে পারবে। আমাদের মানবিক সহায়তা দরকার। এমন মানুষ দরকার, যারা জানেন তারা কী করছেন।’ এ ছাড়া সেখানে বিশেষায়িত ফরেনসিক ও রেসকিউ টিম দরকার। আরেক দল দরকার, যারা মৃতদেহ উদ্ধারে বিশেষজ্ঞ বলে জানিয়েছেন লিবিয়ান ডক্টরস ইউনিয়নের প্রধান মোহাম্মেদ আল ঘৌস।
মেডসো স্যাঁ ফ্রঁতিয়ে বা এমএসএফ বলেছে, ইতোমধ্যেই জরুরি মেডিকেল উপকরণ ও বডি ব্যাগ সরবরাহ করা হয়েছে লিবিয়ার রেডক্রিসেন্টকে। ওদিকে শহরের রাস্তাঘাট এখনো কাদা আর ধ্বংসস্তূপে ঢেকে আছে।
ডেরনার স্থানীয় ফটোসাংবাদিক তাহা মুফতাহ। তিনি বলছেন, ২০১১ সাল থেকে বিশেষজ্ঞরা ডেরনার বাঁধ নিয়ে সতর্ক করে আসছিলেন। তবে কেউ এজন্য কিছু করেনি বলে দাবি করেছেন তিনি। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, বাঁধটা বিমান হামলার মতো করে ধ্বংস হয়ে গেছে।
গত সপ্তাহের রোববারের ঝড়ে সৌশা, আল মারজ ও মিসরাতা শহরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সূত্র: বিবিসি
আজকের সারাদেশ/১৮সেপ্টেম্বর/এএইচ