আজকের সারাদেশ প্রতিবেদন:
চার বছর আগে রেজাউল হক রুবেলের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হওয়ার খবরে-বেশ বিস্ময়ই হয়েছিলেন সবাই। কেননা, রুবেল তখন পর্যন্ত ছিলেন না কোনো অগ্রগণ্য নেতা। সংগঠনের কর্মসূচিতেও সামনের সারিতে তেমন একটা দেখা যেত না তাঁকে। আবার বয়সটাও পক্ষে ছিল না এই নেতার। কেননা ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হওয়া রুবেলের যে ছাত্রত্বই ছিল না তখন। সংগঠন পরিচালনার জন্য যেসব যোগ্যতা ও গুণ থাকা দরকার সেসব অনুপস্থিত থাকলেও কোনো কিছুই সভাপতি হতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি তাঁর সামনে।
এমন একজনকে সভাপতি করা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তখন হতাশ হলেও আশা করেছিলেন, বড় দায়িত্ব পাওয়ার পর হয়তো বদলে যাবেন রুবেল। পদের সম্মান হয়তো তিনি ধরে রাখবেন। কিন্তু সেই আশায়ও গুঁড়েবালি। বরং ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে আসীন হওয়ার পর আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন রুবেল। কখনো নারী নিয়ে আবাসিক হোটেলে রাত্রী যাপন, কখনো আবার অধিনস্ত নেতা-কর্মীদের দিয়ে পা টেপানো, কখনোবা অশ্লীলভাবে হলের কক্ষে শুয়ে থাকা, নারী শিক্ষার্থীদের ইঙ্গিতপূর্ণ খুদে বার্তা পাঠানোর স্ক্রিনশট-ছবি ভাইরাল হওয়া থেকে নারী লাঞ্ছিতকারীদের পক্ষে নেওয়া-বারবার বিতর্ক সঙ্গী হয়েছে রুবেলের। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে এক সময়ের ঘণিষ্ট নেতা-কর্মীরাও রুবেলকে ছেড়ে যাওয়ায় তিনি হয়ে পড়েন একা। এক পর্যায়ে ক্যাম্পাস থেকেই ‘আউট’ হয়ে যান তিনি। পরে ক্যাম্পাসে গোপনে ফিরলেও নিজ পক্ষের নেতা-কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয় তাঁকে।
নানা ঘটনার জের ধরে গত তিনদিন ধরে ক্যাম্পাসে একের পর এক সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগের বেশ কয়েকটি পক্ষ। এর মধ্যেই সংবাদ প্রকাশের জের ধরে রোববার (২৪ সেপ্টেম্বর) রুবেলের অনুসারীরা প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মোশাররফ হোসেনের ওপর হামলা চালায়। এর পর পরই গত কয়েকদিনের ঘটনার প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এতে ছাত্রলীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে।
এদিকে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার পর সন্ধ্যা ছয়টায় নিজের ফেসবুকে ‘বিদায়ী বার্তা’ দেন রেজাউল হক রুবেল। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের সই করা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার বিজ্ঞপ্তিতি শেয়ার করে রুবেল লেখেন, ‘আবারও দেখা হবে নতুন কোনো প্রান্তে। সবার জন্য শুভকামনা রইল। চলার পথের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ বিদায়ী বার্তায় রুবেলের লেখা এই কথাগুলো নিয়েই নতুন করে হাস্যরস হচ্ছে। কেননা, একই কথা যে বিকেল চারটার সময়ই নিজের ফেসবুকে লিখেছেন বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু। রুবেলের এই ‘কপি পেস্ট’ নিয়ে তাই মজা করছেন অনেকেই।
রুবেলের পোস্টের নিচে বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আরিফ লিখেছেন, ‘শেষ লেখাটুকু নিজে লিখতে পারলেন না। সেটাও কপি করতে হইল।’
ছাত্রলীগ কর্মী মো. সুমন সরকারও প্রায় একই কথা লিখেছেন। তিনি লেখেন, ‘শেষ অব্দি অন্যের ক্যাপশনটাও কপি করে দিলেন ভাই।’ একই কমিটির সহসভাপতি রাকিবুল হাসান দিনার অবশ্য রুবেলের সমালোচনা করেছেন ইউনিটকে বারবার বিতর্কিত করা নিয়ে। তিনি লেখেন, ‘ইউনিটটার মান ইজ্জত শেষ কইরা গেলা।’
বারবার বিতর্ক:
রেজাউল হক ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর তিনি ২০১০ সালে স্নাতক ও ২০১৩ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের ছয় শিক্ষাবর্ষের মধ্যে স্নাতক শেষ করতে হবে। আর দুই শিক্ষাবর্ষের মধ্যে স্নাতকোত্তর। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ আট বছর ক্যাম্পাসে থাকতে পারবেন। কিন্তু রেজাউল প্রায় ১৭ বছর ধরে ক্যাম্পাসে আছেন।
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পান রেজাউল। অথচ এর ৬ বছর আগেই তাঁর ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে। সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এ পদের মেয়াদ এক বছর হলেও তিনি সভাপতির পদে ছিলেন প্রায় ৪ বছর। এই চার বছরে বারবার বিতর্ক সঙ্গী হয়েছে রুবেলের্
গত বছরের ১৭ জুলাই ক্যাম্পাসে পাঁচ তরুণের হাতে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন ও মারধরের শিকার হন। ভুক্তভোগী ছাত্রীকে বেঁধে বিবস্ত্র করে মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করেছিলেন পাঁচ তরুণ। এ ঘটনার মূল অভিযুক্ত আজীম হোসেন। তিনি রেজাউলের অনুসারী ছিলেন। এ ঘটনায় আজীমকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।
নিপীড়নের শিকার ছাত্রীর ভাষ্য, আজীমকে বাঁচাতে ঘটনা আড়ালের নানা চেষ্টা চালিয়েছিলেন রেজাউল। প্রক্টর কার্যালয়ে অভিযোগ দেওয়া ও মামলা করতে রেজাউল তাঁকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। এ নিয়ে তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এই বিতর্ক শেষ হতে না হতেই গত ২০ মার্চ রেজাউলের একটি ছবি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় সারাদেশে। ছবিতে দেখা যায়, রেজাউল হলের কক্ষের বিছানায় শুয়ে মুঠোফোন দেখছেন। দুই পাশে বসে তাঁর পা টিপছেন শাখা ছাত্রলীগের দুই নেতা শামীম আজাদ ও শফিউল ইসলাম। রেজাউলের দাবি, তিনি অসুস্থ থাকায় দুই নেতা তাঁর ‘সেবা’ করছিলেন। এরপর গত ১ জুন উপ দপ্তর সম্পাদক রমজান হোসেনকে কুপিয়ে জখম করার অভিযোগ উঠেছিল রেজাউলের বিরুদ্ধে। এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে রেজাউলের একটি ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। একই সময়ে নিজের হলের কক্ষে কাপড় ছাড়া শুয়ে থাকা রুবেলে একটি ব্যক্তিগত ছবিও ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। এর আগে ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর এক তরুণীকে নিয়ে নগরীর আগ্রাবাদ শেখ মুজিব রোডের একটি আবাসিক হোটেলে রাত কাটিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন রুবেল। তখন নারী নিয়ে হোটেলে প্রবেশ করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে রুবেল অপ্রপচার বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
কমিটি বিলুপ্ত হওয়ায় শেষ পর্যন্ত রুবেলকে ১৭ বছর পর ক্যাম্পাস ছাড়তেই হচ্ছে। কিন্তু সেই বিদায় বেলাতেও কপি-পেস্ট করে হাসির পাত্র হলেন তিনি।
কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পেছনেও রুবেলের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডকে দায়ী করছেন সাধারণ সম্পাদক পক্ষের অনুসারীরা। নাম প্রকাশ না করে এই পক্ষের দুজন বলেন, আমরাও চেয়েছিলাম এই শাখায় নতুন কমিটি হোক। কিন্তু এভাবে বিতর্কিতভাবে কমিটি বিলুপ্ত হোক সেটা চাইনি। মূলত রুবেলের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সারাদেশের কাছে এই ইউনিটের মানসম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের বক্তব্যেও নেতাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে যে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে, সেটির আঁচ পাওয়া গেছে। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সাম্প্রতিককালে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত এবং আমাদের দলীয় শৃঙ্খলা ও আদর্শের পরিপন্থী। ইতিবাচক ছাত্ররাজনীতি আমাদের প্রত্যাশা। সেটির ব্যত্যয় হওয়ায় আমরা এই ব্যবস্থা নিয়েছি।’
আজকের সারাদেশ/২৪ সেপ্টেম্বর/এএইচ