সকাল ৬:১২, শনিবার, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যান চলাচলের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না টানেলে

হাবীব আরাফাত, চট্টগ্রাম:

দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নদীর তলদেশের সড়ক টানেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামন টানেল এরই মধ্যে এক মাস পূরণ করেছে। ২৯ অক্টোবর যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু টানেল। এরপর ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ৭৫ হাজার ১৯৭টি যানবাহন বঙ্গবন্ধু টানেল পাড়ি দিয়েছে। আর টোল আদায় হয়েছে ৪ কোটি ১২ লাখ ২১ হাজার টাকা। এসব তথ্য সেতু বিভাগের।

তবে ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু টানেলের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল টানেল চালুর বছরে প্রতিদিন ১৭ হাজার যানবাহন চলবে টানেলে। তখন টানেল চালুর সময় নির্ধারণ ছিল ২০১৭ সাল। পরে ২০২০ সালে দৈনিক ২১ হাজার এবং ২০২৫ সাল নাগাদ দৈনিক ২৮ হাজার গাড়ি চলাচলের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া সম্ভাব্য যান চলাচলের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে আদায় করা টোল থেকে ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে ১২৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে উদ্বোধনের পরবর্তী ৫০ বছরে ০ দশমিক ১৬৬ হারে জিডিপি বৃদ্ধির কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু সেতু বিভাগের তথ্য বলছে, গেল ১ মাসে গড়ে দৈনিক ৫ হাজার ৬৫২ টি যান বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে চলাচল করেছে। আর টানেলে চলাচলকারী যানবাহন থেকে টোল হিসেবে দৈনিক গড়ে আয় হয়েছে ১৩ লাখ ২৯ হাজার ১০০ টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৩২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। যান চলাচলের সংখ্যা ও লক্ষ্যমাত্রার এত বিশাল তারতম্যে টানেল থেকে সরকারের আয়ের লক্ষ্যমাত্র পুরণে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

গেল একমাসে টানেল দিয়ে অধিকাংশই ব্যক্তিগত গাড়ি চলেছে। এখনও টানেল দিয়ে নির্দিষ্ট কোনো রুটের গণপরিবহন চালু হয়নি। তাছাড়া দূর পাল্লার অনেক বাসও এখনও শাহ-আমানত সেতু দিয়ে কর্ণফুলি পাড়ি দেয়। এতে এখনও বঙ্গবন্ধু টানেলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে চলাচলকারী সব যানবাহনের চাপ পড়ছে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী তানভীর রিফা বলেন, ‘টানেল দিয়ে এখনও পুরোপুরি বাণিজ্যিক যান চলাচল শুরু করেনি। কারণ দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও মাতারবাড়ী কেন্দ্রীক অর্থনৈতিক কার্যক্রম এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি।’

অন্যদিকে টানেলের অপারেশনাল ব্যয় ধরা হয়েছে বছরে ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার। আবার প্রতি ৫ বছর পরপর টানেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের প্রতিস্থাপন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে টানেল নির্মাণে ব্যয় করা প্রায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকার মধ্যে দুই শতাংশ সুদে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ দেয় চীন। ২০২৫ সাল থেকে টানেলের আয় দিয়ে সেই ঋণ পরিশোধ করবে সরকার। কিন্তু বর্তমানে যে হারে টোল আদায় হচ্ছে তাতে বছরে আয় হওয়ার কথা ৪৯ কেটি ৪৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা। যা প্রায় ৪ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলারের সমান। সব মিলিয়ে বর্তমান পরিসিস্থিতে টানেলের আয় দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন ব্যয় মেটানোই কঠিন হয়ে পড়বে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

তবে ২০১৩ সালের সমীক্ষায় মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মিরসরাই–কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়ক, মীরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পাঞ্চল ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন নানা শিল্প কারখানা চালু হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং মিরসরাই–কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়ক এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। এমনকি দক্ষিণ চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন শিল্প কারখানাগুলোও এখনও কার্যক্রম পুরোপুরি চালু করেনি। এসবের কারণে শুরুতে তুলনামূলক কম যান চলাচলকে অনেকটা কাঙ্খিত হিসেবেই ধরে নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে টানেলের প্রভাবে আনোয়ারা-পটিয়া এলাকায় ব্যাপক শিল্পায়ন ও বছরে অন্তত ১৭ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের কথা সমীক্ষায় বলা হলেও বাস্তবে এমনটা দেখা যাচ্ছেনা। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও টানেলের পুরোপুরি সুফল পেতে এখন থেকেই চট্টগ্রামে সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা মাথায় রেখে মহাপরিকল্পনা সাজানোর কথা বলছেন নগর পরিকল্পনাবীদরা। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘ফিজিবিলিটি স্টাডিজে অনেক কিছু দেখা যায়, কিন্তু ইনিশিয়ালি এত গাড়ি হবে না। কারণ গাড়ি ওদিকে কী জন্য যাবে? ওখানে কী এমন ইন্ডাস্ট্রি হয়েছে যে গাড়ি যাবে? ওদিক থেকে কেনই বা গাড়ি আসবে? ওখানে তো সেই ডেভেলপমেন্ট টা এখনো হয়নি। কাজেই টানেল দিয়ে এত তাড়াতাড়ি গাড়ি যাবে না। ওরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছে ঠিক আছে, কিন্তু সেদিকে যদি শিল্পায়ন না হয় ওখানে গাড়ি যাবে কেন?’

টানেল দিয়ে যান চলাচল কম হওয়ার কারণ হিসেবে তুলনামূলক বেশি টোলকেও দোষেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের এই নেতা। তিনি বলেন, ‘ওইদিকে যেহেতু আপনার কাজ নাই আপনি তো যাচ্ছেন না, যাবেন না। আর ওই দিকে কাজ থাকলেও আপনি এখন কোন দিক দিয়ে যাবেন? আপনি টানেল দিয়ে গেলে আপনার টোল দিতে হবে কত, আর শাহ আমানত ব্রিজ দিয়ে গেলে টোল দিতে হবে কত? এগুলো তো টাকা, এই চড়া দ্রব্যমূল্যর বাজারে টাকার হিসেব করবে জনসাধারণ।’

‘যাদের কাঁচা টাকা আছে, গাড়ি আছে তারা যাবে। বাস গেলে তো বাসে অনেক টোল নেয়, সাধারণ মানুষ তো বাসে যাবে না। একটা ৩০ সিটের বাস গেলেও তো ৩০০ টাকার টোল নেয় । মানে প্রতি জনের ঘাড়ে দশ টাকা করে বেশি পড়বে। তাহলে তো বাস চালকও যাত্রী পাবে না। সাধারণ মানুষ কেন অতিরিক্ত টাকা পে করবে? এতদিন যেগুলো গেছে প্রথম প্রথম, এগুলো তো সব টুরিস্ট বাস। ফিজিবিলিটি স্টাডিজে যে পূর্বাভাস দিয়েছে, ওই রকম যানবাহন হতে হতে আরো অনেক বছর সময় লাগবে।’

লক্ষ্যমাত্রার টোল আদায় না হলে টানেলটা অনেকটা শ্বেতহস্তীর মত জানিয়ে টানেলের সুফল পেতে দুপাশে পরিকল্পিত নগরায়নের পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘আর এখন টোল ট্যাক্স যদি না পাই এগুলো আমাদের জন্য হোয়াইট এলিফ্যান্ট (শ্বেতহস্তী) হয়ে যাবে। সেটা আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও বেশ কয়েকবছর, ওইদিকে কিরকম শিল্পায়ন হবে, কিরকম ট্রাফিক জেনারেট হবে। আর সবগুলা গাড়ির টানেল দিয়ে আসবেই বা কেন? প্রশ্নে তো অনেক কিছুই আসে। টানেল হয়ে গেছে এখন আর কিছু করার নেই। দু’পাশেই শিল্পায়ন করতে হবে। দুপাশেই পরিকল্পিত নগরায়ন করতে হবে টার্মিনাল করতে হবে এগুলো সবগুলাই করতে হবে। এখন সেগুলো এই পরিস্থিতিতে কবে হবে তার কোন ঠিক নেই।’

অনেকটা একই কথা বলেন আরেক নগর পরিকল্পনাবীদ ও স্থপতি আশিক ইমরান। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামকে ঘিরে আগামির বাংলাদেশকে মাথায় রেখে এখন থেকেই মহাপরিকল্পনা সাজাতে হবে। যাতে এই অঞ্চলে পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল, আবাসিক এলাকা ও পর্যটন নগরী গড়ে তোলা যায়। এখানে এসবের উপাদানগুলোও বিদ্যমান আছে। একাজগুলো করলে টানেল ব্যবহারে পণ্যবাহী যানবাহনের পাশাপাশি অন্যান্য যানবাহনও উৎসাহিত হবে।’#

আজকের সারাদেশ/৩০নভেম্বর/এএইচ

সর্বশেষ সংবাদ

অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ চবি, রাতের মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ

কত টাকা পেল কোপা ও ইউরো চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা-স্পেন?

ঢাবিতে শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষে আহত ১৮২, মেডিকেলেও হামলা

চবিতে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর দফায় দফায় চলছে ছাত্রলীগের হামলা

‘যৌতুক’ হিসেবে হবু জামাইকে বিসিএসের প্রশ্ন দিয়েছিলেন পিএসসি সদস্য

শখের বসে ৩০ বছর ধরে কাচের বাল্ব চিবিয়ে খান রাজশাহীর মুক্তার

নাটোরে ট্রেন থেকে ছিটকে পড়া কয়েক কেজি গাঁজা নিয়ে মানুষের কাড়াকাড়ি

নির্বাচনী সমাবেশে প্রকাশ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গুলি

স্বঘোষিত মেধাবীরা কি বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের পার্থক্য বুঝে না: ছাত্রলীগ সভাপতি

আন্দোলনের নামে অস্থিতিশীলতার চেষ্টা করলে পরিণাম ভালো হবে না: ছাত্রলীগ সেক্রেটারি