সাইফুল আফ্রিদি:
কিংবদন্তী চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি ‘পথের পাঁচালীতে’ ট্রেন দেখার জন্য দুই ভাই বোন ‘অপু-দুর্গা’র আবেগ তুলে ধরেছিলেন দারুণ মুন্সিয়ানায়। সেই অমর ট্রেন-প্রেম বাঙালির নস্টালজিয়ায় চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছে। ৮ বছরের সামির আর ৬ বছরের সাবা যেন বাস্তবের সেই অপু-দুর্গা। দুই ভাই বোন সদ্য চালু হওয়া কক্সবাজার এক্সপ্রেস দেখতে গিয়েছিল বাড়ি থেকে বেরিয়ে। পর্দার অপু-দুর্গা ট্রেন দেখে ফিরলেও ফেরা হলো না সাবা আর সামির। চট্টগ্রাম-মহাসড়ক যে লাল হয়েছে দুই ভাই-বোনের রক্তে!
এখনো জীবন কি বুঝেই না দুই ভাইবোন! ছোট বয়সেই জীবনের মায়া ছেড়ে পাড়ি দিল অসীম আকাশে। বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) স্নিগ্ধ ভোরে ট্রেন আসছে সে খবর ছড়িয়ে গেলো ভেঁপুর বাঁশির শব্দে। প্রতিদিন এক পলক আঁকাবাকা সর্পিলাকার ট্রেন দেখতে ছুটছে শিশুরা। ভেঁপু বাজলেই ট্রেন আসছে, ট্রেন আসছে বলে ভৌঁ-দৌড় ছোট্ট শিশুদের। এ যেন শিশুদের এক আনন্দ মিছিল। এমনই এক স্নিগ্ধ সকালে ট্রেন দেখার আনন্দ মিছিলে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরল ছোট্ট শিশু সামির ও সাবা। প্রথম দেখার আনন্দ যেন ঘরে থাকতে দিলো না সামির ও সাবাকে। হাত ধরাধরি করে তাই দুই ভাই বোন ছুটে গেল ট্রেন দেখতে। তবে ট্রেন দেখার আগেই মহাসড়কে ঘাতক ড্রাইভার নিভিয়ে দিলো দুটো উৎসুক প্রাণ।
বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৯টায় চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা মাইজপাড়ায় ট্রেন দেখতে যাওয়ার পথে এ ঘটনা ঘটে। সামির ও সাবা ওই এলাকার বাসিন্দা সৌদি প্রবাসী নাছির উদ্দিনের সন্তান বলে জানা যায়।
সামির ও সাবাকে হারিয়ে মায়ের আহাজারির শেষ নেই। যে ঘর সবসময় দুই ভাই বোনের কোলাহলে মুখরিত থাকতো সে ঘর এখন শূন্য পড়ে রইবে। মায়ের কোলেও দেখা যাবে না আর সাবাকে। সামির ও সাবা চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে যেন পুরো পাড়াটাই জুড়িয়ে গেল।
বাবা নাছিরউদ্দিন সন্তানদের সুখের জন্যই বিদেশ গিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তার ভাই আবুল গফুর। সুখই যেন তার কাছে শোক হয়ে ধরা দিলো। সন্তান হারানোর এই শোক যেন বাবা নাছিরের কাছে মৃত্যুসম বেদনা। প্রতিদিন তিনি সন্তানদের সাথে কথা বলতেন। সামির, সাবাও নানান আবদারে এটা, ওটা কেনার বায়না ধরতেন। বাবাও পরম স্নেহে সেসব কিনে দেওয়ার আশ্বাস দিতেন। সেসব স্মৃতি আর সামির, সাবার মুখে বাবা ডাক শোনতে পাবে না বলে বুক ফাঁটা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন তিনিও।
তাদের মৃত্যুর বিষয়টি স্থানীয়দের বরাতে নিশ্চিত করে জানিয়েছেন মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশের ইনর্চাজ ইকবাল বাহার। তিনি বলেন, শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের চাপায় আব্দুর রহমান ও সাবার মৃত্যু হয়েছে। তারা রেললাইন দেখতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এমন মৃত্যু দেখে স্থানীয়রা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। যান চলাচল বন্ধ থাকে এক ঘন্টা। পরে পুলিশের উপস্থিতিতে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
সামির সাবার মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমেছে। পাড়া প্রতিবেশীরা ভিড় করছে নিথর সামি ও সাবাকে শেষবার দেখতে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেন দেখার উদ্দেশ্যে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পার হচ্ছিল দুই ভাই-বোনসহ তিন শিশু। পথিমধ্যে একটি দ্রুতগতির বাস তাদের চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলে দুজন নিহত হয়। আহত হয় অপর এক শিশু। দুই শিশু নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মালুমঘাট হাইওয়ে থানার ইনচার্জ ইকবাল বাহার।
মাইজপাড়া গ্রামের সরদার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন ট্রেনটি দেখতে সবার মধ্যে একটা আগ্রহ রয়েছে। প্রতিদিন সকালেই শিশুরা ট্রেন দেখতে যায়। আজকেও তারা যাচ্ছিল। মহাসড়ক পার হওয়ার সময় একটি বাস তাদের চাপা দিয়ে পালিয়ে গেছে।’
আজকের সারাদেশ/একে