আরাফাত হাবিব:
বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের দেশীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান কর্ণফুলী নদীর। এই নদী পারাপারে একসময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাহন ছিল সাম্পান নৌকা। সাম্পান এ অঞ্চলে কতটা জনপ্রিয় ছিল তার প্রমাণ মেলে সমৃদ্ধ সাহিত্য সংস্কৃতিতে। আঞ্চলিক গানের বিখ্যাত শিল্পী শেফালী ঘোষের কাল জয়ী ‘ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দেওয়ানা..’ কিংবা ‘মন হাছাড়া মাঝি তোর সাম্পানওত চৈত্যোন্ন…’ গানগুলোতে ওঠে এসেছে সাম্পানের কথা। তবে কালের বিবর্তনে সেই সাম্পানের এখন আর দেখা মেলে না।
শুধু সাম্পান নয়, নদীমাতৃক বাংলাদেশে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে পুরোনো অনেক থেকে অযান্ত্রিক নৌযান। সাম্পানসহ হারিয়ে যাওয়া সেসব নৌযান নিয়ে একটি নৌকা জাদুঘর তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রামে। জেলা প্রশাসন নির্মিত ফৌজদারহাট ডিসি পার্কের পাশেই নির্ধারণ করা হয়েছে এই জাদুঘরের স্থান। এর পাশেই নির্মাণ করা হবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ ও পৃথক জাদুঘর।
প্রাথমিকভাবে ডিসি পার্কে চলমান ফুল উৎসবে প্রদর্শন করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ১৫টি নৌকা। দেশের নদনদী থেকে হারিয়ে যাওয়া এসব নৌকার পাশাপাশি থাকবে প্রতিটি নৌকার ইতিহাসও। শুধু তাই নয়, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে জেলেদের সংগ্রামের চিত্রও থ্রী-ডি প্রযুক্তির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হবে জাদুঘরে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফকরুজ্জামান বলেন, ‘শুধু চট্টগ্রাম নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নৌকা, যেমন কোথাও বজরা নৌকা রয়েছে, কোথাও ময়ূরপঙ্খী, কোথাও পানশি কোথাও ডিঙ্গি, কোথাও বিগ, কোথাও আলিয়ার ডাঙ্গা, আর কোথাও বাঁশের ভেলা রয়েছে। একেকটি অঞ্চলে একেকটি নদী একেক ধরনের নৌকা এবং সেই নৌকার যে ইতিহাস। তা আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্য এই জাদুঘরটি করতে যাচ্ছি।’
ডিসি পার্কের ফুল উৎসবে নৌকা প্রদর্শনীর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে আমরা যে ফুল উৎসবের আয়োজন করেছি, এর একটি কর্ণাবে ১৫টি নৌকার প্রদর্শনী রেখেছি। এই ১৫টি নৌকার মধ্যে দুই ধরনের সাম্পান রয়েছে। একটি বড় ধরনের সাম্পান আরেকটি ছোট সাম্পান। এর বাইরে চাঁদ নৌকা রয়েছে, পানশি রয়েছে, বজরা রয়েছে, বিগ রয়েছে। সামনে আরও কিছু নৌকা যুক্ত হবে।’
নৌকা জাদুঘরের কাজ ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে শুরু হবে জানিয়ে আবুল বাশার মোহাম্মদ ফকরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের নৌকা জাদুঘরের কাজ কিছুদিনের মধ্যে শুরু করতে যাচ্ছি। নৌকা জাদুঘরে শুধুমাত্র এই নৌকাগুলোর প্রদর্শনী থাকবে সেটি নয়। এর বাইরে নৌকার সঙ্গে পাল, দাড় ও বৈঠা থাকবে। এর পাশাপাশি সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে জেলেরা কী ধরনের সমস্যায় পড়ে থাকে অনেক সময় ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে টর্নেডো হয়ে থাকে। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে থ্রী-ডি ইফেক্ট দিয়ে দর্শকদের জন্য সেই চিত্র ফুটিয়ে তোলার। যাতে করে আমাদের দর্শনার্থীরা বুঝতে পারেন বাস্তবিক একটি অনুভূতি। সে বিষয়গুলো তুলে নিয়ে আসার পরিকল্পনা আছে আমাদের। আমরা আশা করছি সে কাজটি কিছুদিনের মধ্যে করতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘নৌকা জাদুঘরের জন্য ফৌজদারহাট যে ডিসি পার্ক হয়েছে, তার পাশেই স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। তার পাশেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ এবং জাদুঘর হবে। সেখানে নৌকা জাদুঘরটি করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। এছাড়া স্থান নির্বাচনের পর আমরা তিনটি ধাপে নৌকা জাদুঘর বাস্তবায়ন করতে চাই। একটি স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা, একটি মধ্যমেয়াদী এবং একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার আলোকে করতে চাই। স্বল্পমেয়াদী যেটি, তার আওতায় আমরা ইতিমধ্যে নৌকাগুলো তৈরি করে নিয়ে আসছি, সামনে আরও কিছু নৌকা আসবে। প্রায় শতাধিক নৌকা যেন আমরা আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে মিউজিয়ামটিতে স্থাপন করতে পারি, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।’
নৌকা জাদুঘরের অর্থায়নের বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের যে ডিসি পার্ক, ফুল উৎসব বা নৌকা জাদুঘরের কাজগুলো আমরা করেছি, সেটা চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সীমিত অর্থের মাধ্যমে করেছি। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় আমাদের দুটি প্রজেক্টের একটি অনুমোদন হয়েছে, আরেকটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। যে প্রকল্পটি অনুমোদন হচ্ছে সেটা কিছুদিনের মধ্যে অর্থ ছাড় হবে। যে প্রজেক্ট অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে, সেটা অনুমোদন হয়ে গেলে আমাদের বিশ্বাস যে নৌকা জাদুঘরের কাজ শুরু হবে।’
বছর দেড়েক আগে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে সাগর পাড়ে মাদকের আখড়া উচ্ছ্বেদ করে ১২৭ রকমের ফুলের লক্ষাধিক গাছ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ডিসি পার্ক। সেই পার্কে দ্বিতীয় বারের মত গত ২৫ জানুয়ারি শুরু হয়েছে ফুল উৎসব। সেই উৎসবে প্রতিদিন অংশ নিচ্ছেন হাজার হাজার ফুলপ্রমী পর্যটক।
আজকের সারাদেশ/০১ফেব্রুয়ারী/এএইচ