আজকের সারাদেশ প্রতিবেদন:
কথিত আছে যে ভ্যালেন্টাইন নামের একজন বিশপ, যিনি প্রেমে বিশ্বাস করতেন, তিনি সৈন্যদের বিয়ে দিয়ে তা উদযাপন করতেন, এভাবে তিনি তৎকালীন সাম্রাজ্যের ডিক্রিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস ক্লডিয়াস ২১৪ থেকে ২৭০ সাল পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্য শাসন করেছেন। তার শাসনামলে তিনি সৈন্যদের বিয়ে করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যে যোদ্ধার কোনো পারিবারিক বন্ধন নেই, সে ততো বেশি সাহসী। কারণ তখন ওই যোদ্ধা তার জীবনের ঝুঁকি নিতে কম ভয় পায়।
ভ্যালেন্টাইন নামে আরেক ধার্মিক ব্যক্তিকে ঘিরে ভিন্ন ধরনের গল্প রয়েছে। ওই গল্প অনুযায়ী তিনি রাস্তায় রাস্তায় গোলাপ বিতরণ করতেন। আরেকটি গল্প অনুসারে ভ্যালেন্টাইন নামে একজন কাগজে হৃদয় কেটে সৈন্যদের দিতেন, যাতে তারা সেই কার্ডগুলি দেখে তার প্রিয়জনকে মনে রাখতে পারে।
এমন গল্পও আছে যেখানে ভ্যালেন্টাইন নামে একজন ধর্মযাজক তার প্রভাবশালী আত্মীয়দের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি প্রেমের প্রকৃত অনুভূতি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
সেই উপলব্ধি থেকে তিনি একজন খ্রিস্টান তরুণ এবং তার প্যাগান বান্ধবীর মধ্যে মিলনকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে অর্থাৎ তাদের বিয়ে দিতে সম্মত হয়েছিলেন।প্যাগানরা মূলত বহু-ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। যাদের সাথে খ্রিস্টানদের ব্যাপক বিরোধ ছিল।
ভ্যালেন্টাইন নামে একাধিক সেইন্ট
ক্যাথলিক সেইন্টদের রেকর্ড অনুযায়ী, ভ্যালেন্টাইন নামে মোট ১১ জন সেইন্ট আছেন। তাদের মধ্যে অন্তত তিনজন প্রেমের বার্তা ছড়ানোর জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন।
সেইন্টদের জীবনী বা হ্যাজিওগ্রাফি গবেষক, ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অফ সাও পাওলো (ইউনিফেস্প) এর গবেষক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হ্যাজিওগ্রাফি সোসাইটির সহযোগী থিয়াগো মায়েরকি এই তথ্য দিয়েছেন।
“এই তিনটি চরিত্র নিয়ে প্রায়ই বিভ্রান্তি দেখা দেয়, একজনের সাথে আরেকজনকে গুলিয়ে ফেলা হয়”, তিনি বলেন।
“গির্জা বা চার্চে যে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে উদযাপন করা হয় তিনি, রোমের সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন।”
“তার সাথে একজন ডাক্তারের গল্পও মিলে যায় যিনি পরবর্তীতে একজন ধর্মযাজক হয়েছিলেন এবং সম্রাটের আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে সৈন্যদের বিয়ে দেয়া উদযাপন করেছিলেন।” “কিন্তু তার আসলেই কোনো অস্তিত্ব ছিল কি না, সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে”, গবেষক মায়েরকি উল্লেখ করেন।
যদি একজন ভ্যালেন্টাইনকে আরেকজন ভ্যালেন্টাইন থেকে আলাদা করা কঠিন হয় তবে এটা প্রমাণ করা আরও কঠিন হবে যে সত্যিই কী ঘটেছে। সেই সঙ্গে এই প্রশ্নও ওঠে যে শত শত বছর ধরে চর্চিত এই কিংবদন্তি চরিত্রের আদৌ কোনো অস্তিত্ব ছিল নাকি সবই মনগড়া?
যেহেতু ১৪ই ফেব্রুয়ারি উদযাপন করা চরিত্রটি নিয়ে ক্যাথলিক ধর্মে এতো বিতর্ক রয়েছে, ফলে বাস্তবতা কী এবং পৌরাণিক কাহিনী কী তা নিশ্চিত করতে না পারায় ক্যাথলিক চার্চ নিজেরাই তাদের প্রথাগত লিটার্জিকাল ক্যালেন্ডার থেকে ১৪ই ফেব্রুয়ারির উৎসবটিকে সরিয়ে দেয়।
১৯৬০ সালে দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিলের পরে তা করা হয়। তারপরও সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের সম্মানে কিছু কিছু সম্প্রদায় আজও এই উৎসব উদযাপন করে, যেখানে ঐতিহ্য বেশ শক্তিশালী।
পৌরাণিক কাহিনীর জন্ম যেভাবে
চার্চের দাপ্তরিক নথিতে, বেশ সংক্ষেপে এ সংক্রান্ত তথ্য দেয়া আছে। সেই তথ্য থেকে একজন ভ্যালেন্টাইনকে অন্য ভ্যালেন্টাইনের থেকে আলাদা করা যায় না। রোমান মার্টায়রোলজি, যেখানে সেইন্টদের জীবনী পাওয়া যায়, সেখানেও এ সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেয়া আছে।
সেখানে ১৪ই ফেব্রুয়ারি, সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে তিনি “রোমে, ভিলা ফ্ল্যামিনিয়ায়, মিলভিয়ান ব্রিজের পাশে” মারা গিয়েছিলেন। এরচেয়ে বেশি কোনো তথ্য দেয়া হয়নি।
“দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিলের আগে বিভিন্ন বিশেষ দিন উদযাপনের বিষয়ে যে বই প্রকাশ হয় সেই মিসালেও বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়নি।”
“তবে সেখানে বলা হয়েছে যে ভ্যালেন্টাইন একজন ধর্মযাজক এবং শহীদ ছিলেন। ২৭০ সালের দিকে তিনি মারা গিয়েছিলেন”, বলেছেন ব্রাজিলের অ্যাকারাউ ভ্যালির স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও সেইন্টদের জীবনী গবেষক ড. হোসে লুই লিরা।
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, ভ্যালেন্টাইনস ডে সম্পর্কে এখন যেসব কল্পনাপ্রসূত ধারণা পাওয়া যায় সেগুলো মূলত সম্পূর্ণ “মৌখিক এবং লিখিত সাহিত্য”।
তার মতে, যারা প্রথম খ্রিস্ট ধর্মে গ্রহণ করেছিল তাদের নিয়ে নানা গল্প কথা প্রচলিত আছে তাদের মতো এদের নিয়েও নানা গল্পকথা তৈরি হয়েছিল।
আর এই রীতিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমে আরও শক্তিশালী আসন গেড়ে বসে। যতদিন পর্যন্ত না চার্চ এগুলোকে একটা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।
গল্পের পেছনে গল্প
এত দ্বন্দ্বের মধ্যে, আসল ভ্যালেন্টাইনস ডে কী হতে পারে সেই তথ্য বিভিন্ন সূত্র দ্বারা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে।তৃতীয় শতকে রোমে বসবাস করেছেন, আবার সে সময় তৎকালীন সম্রাট ক্লডিয়াসের সরকারের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেন এসব তথ্য থেকে ওই প্রেমের সেইন্টকে খুঁজে বের করা সম্ভব।
সেইন্টদের জীবনী বা মার্টায়রোলজিতে বলা হয়েছে, এই ইতিহাসের সাথে রোমের টাইবার নদীর উপর মিলভিয়ান সেতুর অস্তিত্ব জুড়ে আছে।
“এই সেতুটি প্রায় ২০৭ সাল থেকে আছে”, লিরা জোর দিয়ে বলেন। “এটি দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের সময়, ব্যাটেল অব মেটাউরোর ফিরে আসা উপলক্ষে নির্মাণ করা হয়েছিল।”
এটিও বিশ্বাস করা হয় যে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন শহীদ হয়েছিলেন, তখনকার যুগে অনেক বিশিষ্ট খ্রিস্টানদের মেরে ফেলার বিষয়টি সাধারণ ছিল। বিশেষ করে রোম সাম্রাজ্যের আদেশ পালন না করলে তাদের মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেয়া হতো।
তার মৃত্যুর তারিখ ১৪ই ফেব্রুয়ারি হওয়ার বিষয়টি সম্ভবত একটু দেরিতে সামনে এসেছে। এখানে চার্চ তাদের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় একটি সুবিধাজনক সময় বেছে নিয়েছে।
বিশেষ করে চতুর্থ শতক থেকে যখন খ্রিস্টান ধর্ম আনুষ্ঠানিক ধর্মে পরিণত হয়, যার লক্ষ্য ছিল নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্যাগানদের আচার অনুষ্ঠানগুলো তুলে দেয়া।
“এমনকি খ্রিস্টান ধর্ম এখন আনুষ্ঠানিক রূপ পেলেও, প্রথমে রোমানদের প্যাগান বা পৌত্তলিক রীতিগুলো খ্রিস্টধর্মের সাথে সহাবস্থান করতো”, বলেছেন ভ্যাটিকানবাদী ফিলিপ ডমিঙ্গুয়েস, রোমের পন্টিফিকাল গ্রেগরিয়ান ইউনিভার্সিটির ডাক্তার এবং রোমের লে সেন্টারের ডেপুটি ডিরেক্টর।
“সেই সময়ের চার্চ ধীরে ধীরে প্যাগান বা পৌত্তলিক রীতিগুলো দমন করার জন্য নিজেদের কিছু উৎসব, স্মৃতিস্মারক এবং অভ্যাস তৈরি করতে শুরু করে।”
“প্যাগান মন্দিরগুলোকে গির্জায় পরিণত করা হয় এবং আচারগুলোকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা শুরু হয় সেই সময় থেকে”, তিনি যোগ করেন।
এই কারণে, ৪৯৬ সালে, পোপ গেলাসিয়াস (৪১০ থেকে ৮৯৬ সাল) ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করা উচিত বলে প্রতিষ্ঠা করেন। সিদ্ধান্তটি আকস্মিকভাবে নেয়া হয়নি।
আজকের সারাদেশ/এমএইচ