আজকের সারাদেশ প্রতিবেদন:
বাসের ধাক্কায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দুই শিক্ষার্থী নিহতের জেরে পরিবহন ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় রোববার ভোর ৬টা থেকে চট্টগ্রাম গণপরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট চলছে। এই ধর্মঘটের কারণে শহর ছেড়ে যায়নি কোনো বাস। নগরীতেও ঘুরছে না বাসের চাকা। এ কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা।
দূরপাল্লার বাস না চলায় চাহিদা বেড়েছে প্রাইভেটকার ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার। আর এই সুযোগে চালকেরা দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করছেন। একইভাবে নগরীতেও বাস চলাচল না করায় টেম্পো ও রিকশা নিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে নগরবাসীকে। বাস না চলায় এসব গাড়ির চালকেরাও ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন।
রোববার (২৮ এপ্রিল) বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর সবচেয়ে বড় বাস টার্মিনাল বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পড়ে রয়েছে শত শত গাড়ি। টিকিট কাউন্টারগুলোও তালা দেওয়া। চালক ও সহকারীরা বিভিন্ন দোকান ও গাড়িতে বসে খোশগল্প এবং মুঠোফোনে লুডু খেলায় ব্যস্ত সময় পার করছিলেন।
জানতে চাইলে চালকদের অনেকেই ধর্মঘট নিয়ে ক্ষোভের কথা জানান। তবে কেউই পরিবহন নেতাদের ভয়ে নাম প্রকাশ করতে চাননি।
চট্টগ্রাম-বাঁশখালী রুটে চলাচল করা সুপার সার্ভিসের দুজন চালক বলেন, ‘ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে। পরিবহন নেতারা সেই সড়কে ধর্মঘটের ডাক দিতে পারতেন। কিন্তু ঢালাওভাবে পাঁচ জেলায় পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়ে যাত্রীদের যেমন ভোগান্তিতে ফেলেছেন, তেমনি আমাদের পেটেও আঘাত করেছেন। কেননা গাড়ি চললেই তো আমাদের পেটে খাবার পড়ে, না চললে কে দেবে খাবার?’
এই টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রামের দক্ষিণের প্রায় সব জেলার পাশাপাশি উত্তরের উত্তরের কয়েকটি উপজেলায়ও গাড়ি যায়। প্রতিদিন অন্তত দশ হাজার যাত্রী এই টার্মিনাল হয়ে গন্তব্যে যান। কিন্তু গাড়ি না চলায় তাঁরা পড়েছেন মহা ঝামেলায়।
এই টার্মিনাল থেকে আধা কিলোমিটার দূরে চান্দগাঁও থানা মোড় এলাকা থেকে কক্সবাজারে যাওয়ার বেশ কয়েকটি পরিবহনের কাউন্টার রয়েছে। সেখানে গিয়েও একই চিত্র দেখা গেছে। চলছে না কোনো বাসই।
মারচা নামের একটি পরিবহনের একজন চালক বলেন, ধর্মঘটের কারণে সকাল থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। যাত্রীরা এসে তাই ফিরে যাচ্ছেন।
কক্সবাজারে যেতে এই স্টেশনে এসেছিলেন একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) কর্মী শাহাদাত হোসেন। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, কর্মস্থলে যোগ দিতে কক্সবাজার যেতে বাসা থেকে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু স্টেশনে এসে দেখি কোনো গাড়িই চলছে না। বাধ্য হয়ে প্রাইভেটকারে দ্বিগুণ ভাড়ায় কক্সবাজার যেতে হচ্ছে।
দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে শহরের প্রধান প্রবেশমুখ চাক্তাইয়ের নতুন ব্রিজ এলাকা। বেলা সাড়ে ১১টায় সেখানে গিয়ে দেখা যায় মানুষদের প্রচুর ভিড়। বাস না চলায় কোনো প্রাইভেটকার আসলেই সেটি ঘিরে ধরছেন যাত্রীরা। সেই সুযোগে যেখানে আগে ১০০ টাকায় পটিয়া-চন্দনাইশের গন্তব্যে যাওয়া যেত সেই ভাড়া এখন দাবি করা হচ্ছে ২০০ টাকা।
কেন বেশি ভাড়া দাবি করছেন সেটি জানতে চাইলে মোহাম্মদ রশিদ নামের একজন প্রাইভেটকার চালক বলেন, ‘ধর্মঘটে ঝুঁকি নিয়ে সড়কে বেরিয়েছি। ধর্মঘটে গাড়ি চালানোর জন্য যে কোনো সময় হামলার শিকার হতে পারি। সেজন্য যাত্রীদের কাছ থেকে চেয়ে কিছু ভাড়া বেশি নিচ্ছি।’
বাস না চলায় কেউ কেউ ট্রাকে-পিক আপে চড়েও ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যে ফিরছিলেন।
পরিবার নিযে চন্দনাইশে ফিরতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েন রানী দাশ। তিনি বলেন, জরুরি বাড়ি যেতে হচ্ছিল। কিন্তু বাস না চলায় বিপদে পড়েছি। এখন বাধ্য হয়ে দ্বিগুণ ভাড়ায় প্রাইভেটকারে যেতে হচ্ছে। আমাদের অপরাধটা কোথায় বুঝতেছি না।
একইভাবে উত্তর চট্টগ্রাম থেকে নগরীতে প্রবেশের তিন মুখ একেখান, অক্সিজেন ও কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায়ও যাত্রীদের ভোগান্তির শেষ নেই। এই তিন স্টেশনেও দূরপাল্লার বাসের সব কাউন্টার বন্ধ। প্রাইভেটকার, অটোরিকশা, ট্রাক-মানুষ যে যেভাবেই পারছে গন্তব্যে ফিরছে।
গত শনিবার (২৭ এপ্রিল) দুপুরে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটের এই ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে অবশ্য তিনটি পরিবহন সংগঠন ধর্মঘট প্রত্যাখানের ঘোষণা দেয়। কিন্তু এই সংগঠগুলো টেম্পোজাতীয় পরিবহন সংশ্লিষ্ট। ফলে তাদের প্রত্যাখানে তেমন একটা লাভ হচ্ছে না।
গত সোমবার (২২ এপ্রিল) চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী দুই চুয়েট শিক্ষার্থী নিহত হয়। এর জের ধরে ওইদিন থেকেই শিক্ষার্থীরা ১০ দফা দাবিতে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করে আসছিলেন। গত ২৪ এপ্রিল ঘাতক বাসের চালককে পুলিশ গ্রেফতার করে। এরপরও ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামাতে ২৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করলে ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষার্থীরা গণ পরিবহনে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর প্রতিবাদে পরিবহন ধর্মঘটের ঘোষণা দেওয়া হয়।
আজকের সারাদেশ/টিএইচ/এমএইচ