আজকের সারাদেশ প্রতিবেদন:
লোহিত সাগরে হুথিদের হামলার প্রভাবে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হয়ে আন্তর্জাতিক রুটের পরিবহন ব্যয় (ফ্রেইট চার্জ) দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। লোহিত সাগারের অস্থিরতায় সরবরাহ শৃঙ্খলায় ধীরগতি ভর করেছে। জাহাজ ও কনটেইনার জট দেখা দিয়েছে সাংহাই, নিংবো, সিঙ্গাপুর ও কলম্বোর মতো প্রধান আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোতে। কনটেইনার খালাস বা লোডিংয়ে বিলম্বের কারণে গত ছয় মাসে বাংলাদেশ-চীন রুটে জাহাজে পণ্য পরিবহনের ভাড়া (ফ্রেইট চার্জ) দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে।
কনটেইনার শিপিং অ্যানালাইসিস ফার্ম– লাইনারলিটিকার তথ্যমতে, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ট্রান্সশিপমেন্ট রুট সিঙ্গাপুর বন্দরে জাহাজের বার্থিং পেতে স্বাভাবিক সময়ে ৩৬ ঘণ্টার মতো লাগত। কিন্তু লোহিত সাগরের চলমান অস্থিরতায় বর্তমানে সময় লাগছে প্রায় ৭ দিন। সিঙ্গাপুর বন্দরে ৫০ শতাংশ এবং কলম্বো বন্দরে প্রায় ১৫ শতাংশ ভাড়া বেড়েছে।
শিপিং কোম্পানিগুলোর তথ্যমতে, লোহিত সাগরে হুথিদের হামলার কারণে বাংলাদেশ ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে চলাচলকারী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য আফ্রিকা ঘুরে যেতে হচ্ছে। এতে এশীয় অঞ্চল তথা চীন থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত সময় লাগছে কমপক্ষে ১৫ দিন। এরমধ্যে ডেনমার্ক -ভিত্তিক শিপিং কোম্পানি মায়েরস্ক লাইন হংকংসহ দক্ষিণ চীন থেকে বাংলাদেশ রুটে পিক সিজন সারচার্জ যুক্ত করতে চলেছে ৭০০ ডলার থেকে ১,৪০০ ডলার পর্যন্ত। আগামী ১৫ জুন থেকে এটি কার্যকর হবে।
বৈশ্বিক একটি শিপিং কোম্পানিগুলোর বাংলাদেশ অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিঙ্গাপুর ও চীনের বন্দরগুলোয় জটের কারণে বাংলাদেশে বেশিরভাগ আমদানি পণ্য, বিশেষত শিল্পের কাঁচামাল, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, যন্ত্রপাতির সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। এসব পণ্য চীন থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে বাংলাদেশে আসে। আবার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর যেমন সিঙ্গাপুর, পোর্ট কেলাং, কলম্বো, তানজুম পেলাপাস বন্দর হয়ে চীনসহ ইউরোপ আমেরিকার বন্দরে পণ্য পরিবহন হয়। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মাধ্যমে তৃতীয় একটি দেশের বন্দর ও পরিবহন ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে প্রতিবেশী বা অন্য কোন দেশ তাঁদের পণ্য পরিবহন করে থাকে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ ইকবাল আলী শিমুল জানান, লোহিত সাগরে হুথিদের হামলার কারণে ঘুরপথে পণ্য পরিবহন এবং সিঙ্গাপুর, চীনসহ বিভিন্ন দেশের বন্দরে জাহাজ ও কনটেইনার জট; উভয় কারণে ফ্রেইট চার্জ এখন আকাশছোঁয়া। বন্দরে কনটেইনার আটকে থাকায় সমুদ্রপথে চলাচলকারী জাহাজের সংখ্যাও কমে গেছে। ফলে শিপিং কোম্পানিগুলোও যে যার মতো ভাড়া বাড়িয়েছে।
শিপিং এজেন্টরা বলেছেন, আমেরিকা এবং ইউরোপ উভয় গন্তব্যের জন্য কনটেইনারের ফ্রেইট চার্জ প্রাক-কোভিড সময়ের হারকে ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম চীন রুটে একটি ২০ ফুটের কনটেইনার (টিইউ) পরিবহনের ভাড়া ২,১০০ থেকে ২,৫০০ ডলার। ছয় মাস আগেও যা ছিল ৮০০ থেকে ১ হাজার ডলার। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর বন্দরে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া (ফ্রেইট চার্জ) ৩০০ ডলার এবং কলম্বো বন্দরে ২৩০ ডলার। অর্থাৎ তা যথাক্রমে ৫০ ও ১৫ শতাংশ বেড়েছে।
শিপিং কোম্পানি গ্লোবাল লিংক অ্যাসোসিয়েটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মইনুল হক চৌধুরী বলেন, বার্থিং পেতে কনটেইনার নিয়ে সিঙ্গাপুর বন্দরে দিনের পর দিন অপেক্ষা করছে জাহাজ। এর প্রভাব পড়েছে ফ্রেইট চার্জে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক পরিচালক ও ক্রাউন ন্যাভিগেশনের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহেদ সারোয়ার বলেন, করোনা মহামারির আগে আমেরিকায় কন্টেইনার ভাড়া ছিল ৩,৫০০ ডলার। করোনার সময় সেটি বেড়ে ১২ থেকে ১৪ হাজার ডলারের বেশি হয়ে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে সেটি নেমে আসে ৩ হাজার ডলারের নিচে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে লোহিত সাগরে হুথিদের হামলা এবং ইরান- ইসরায়েল অস্থিরতার প্রভাবে আমেরিকার গন্তব্যে কনটেইনার ভাড়া বেড়ে ৪,৫০০-৫,০০০ ডলার হয়েছে। একইভাবে করোনার সময় ইউরোপে ২ হাজার ডলার থেকে বেড়ে ফ্রেইট চার্জ হয় ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত। সেটি একপর্যায়ে ১,৫০০ ডলারে নেমে এলেও– বর্তমানে এই ভাড়া আবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩,০০০ থেকে ৩,৫০০ ডলারে।
শুধু কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের খরচই বেড়েছে এমন নয়। বাল্ক ক্যারিয়ারের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনের খরচও ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
মেঘনা ওশেন-গোয়িং ফ্লিটের মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মোহাম্মদ আবু তাহের জানান, বর্তমানে বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজের ফ্রেইট চার্জও ঊর্ধ্বমুখী। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজে দৈনিক ভাড়া ছিল– এশীয় অঞ্চলে ২০ থেকে ২৫ হাজার ডলার। ইউরোপ-আমেরিকা অঞ্চলে এই ভাড়া ছিল ৪০ থেকে ৪৫ হাজার ডলার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বৈশ্বিক বাণিজ্য কমে যায়। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে আলট্রাম্যাক্স-আকারের জাহাজের ভাড়া এশীয় অঞ্চলে ১০ হাজার ডলার ডলার এবং ইউরোপ-আমেরিকা অঞ্চলে ভাড়া ২০ হাজার ডলারে নেমে এসেছিল।”
এদিকে ফ্রেইট চার্জ বৃদ্ধি এবং কনটেইনার জটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। বর্তমানে ফেব্রিক আমদানি করতে সময় লাগে প্রায় এক মাস। কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকায় ঘুরপথে পণ্য পাঠানোর কারণে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এখন ১৫ দিনের বেশি সময় লাগছে। ফলে ডেলিভারিতে দেরী হচ্ছে। অথচ বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বি ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার কাঁচামাল ৭ দিনে পৌঁছায়। একারণে ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়াসহ কম সময়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে পারে এমন দেশে চলে যাচ্ছে।
বিজিএমইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশের পোশাকখাত টাইম বাউন্ড চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। “ফ্রেইট চার্জ বৃদ্ধি এবং (পণ্য ডেলিভারিতে) সময় বেশি লাগার কারণে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ পরিবর্তে বিকল্প দেশে চলে যাচ্ছে। তাদের টাইম ফ্রেম পূরণের জন্য অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে বিদেশি ক্রেতারা।”
এদিক অভ্যন্তরীণ রুটেও পণ্য পরিবহন ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ডিপোগুলোতে রপ্তানি পণ্য পরিবহনে– কাভার্ড ভ্যানের ভাড়া আগে ছিল ১৫ হাজার টাকা। বর্তমানে সেই ভাড়া বেড়ে ২২ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মোহাম্মদ শামসুল আজম বলেন, “কয়েক মাস আগেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকায় পণ্যবোঝাই কনটেইনার পরিবহনের গড় খরচ ছিল ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু সম্প্রতি তা বেড়ে হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। ক্রমাগত ভাড়া বাড়ার ফলে তৈরি পোশাক পণ্য উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।”
আজকের সারাদেশ/জেএম