সকাল ৬:৫৮, মঙ্গলবার, ২৭শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কালেমা পড়তে পড়তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শাহেদ

আজকের সারাদেশ প্রতিবেদন

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভেতরের এক কোণায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন সাজ্জাদ মিয়া। ৩০ বছরের তরুণের মুখজুড়ে ক্লান্তির ছাপ। চোখ চিকচিক করছে স্বজন হারানোর কষ্টে। রিয়াজউদ্দিন বাজারের মোহাম্মদী প্লাজায় বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) মধ্যরাতে ধরা আগুন এই ব্যবসায়ী যে হারিয়েছেন তাঁরই দোকানের একনিষ্ঠ কর্মী ১৮ বছরের মোহাম্মদ শাহেদকে।

বেঁচে থাকার জন্য মুঠোফোনে শাহেদের আকুল করা অনুরোধ, দমবদ্ধ হয়ে পড়া এবং শেষে কোনো উপায় না দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার আগে কালেমা পড়ে বিদায় নেওয়া-সেই সব ভয়ংকর মুহূর্ত এখন কানে বাজছে সাজ্জাদ মিয়ার। মনটা তাই বিষন্ন হয়ে আছে-শাহেদকে বাঁচাতে না পারার দুঃখে-ব্যথায়।

সাজ্জাদ মিয়া তুলে ধরেন শাহেদের সঙ্গে শেষবার কি কথা হয়েছিল তার পুরোটা। বলেন, ‘শুক্রবার মার্কেটে বন্ধ থাকায় আমি প্রতিবারের মতো বৃহস্পতিবার রাতে সাতকানিয়ার গ্রামের বাড়িতে যাই। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত সাড়ে ১২টা বেজে যায়। শরীর ক্লান্ত থাকায়-দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ি। এরই মধ্যে রাত পৌনে ২টায় শাহেদের ফোন পেয়ে জেগে ওঠি। ফোন দিয়েই সে ভয়ার্ত কণ্ঠে জানাতে থাকে-‘‘পাশের মোহাম্মদী মার্কেটে ধরা আগুন আমাদের রিজওয়ান কমপ্লেক্সেও ছড়িয়ে পড়েছেছে। আমি আমার বাসায় আটকা পড়েছি। আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন।’’ এরপর আমি আশপাশের সবাইকে ফোন দিয়ে শাহেদকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে বলি। পরে আমিও মোটরসাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে শহরের উদ্দেশে রওনা দিই।’

শাহেদকে বের হয়ে আসার জন্য বারবার বলেছেন সাজ্জাদ মিয়া। কিন্তু একদিকে ধোয়ার কুণ্ডুলী, অন্যদিকে অন্ধকার-শাহেদ চেষ্টা করেও তাই বের হতে পারেননি বাসা থেকে। এক পর্যায়ে বাসার টয়লেটে ঢুকে ধোঁয়া থেকে বাঁচার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানেও ধোঁয়া থাকে ঘিরে ধরে। পরে দমবন্ধ হয়ে সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর।

সাজ্জাদ মিয়া বলেন, ‘আমি শাহেদকে বারবার বলতে থাকি মুখে ভেজা কাপড় বেঁধে মার্কেটের ছয় তলায় ওঠে যেতে। সে আমাকে জানায়-চারদিকে অন্ধকার আর ধোঁয়ার কারণে সে বের হতে পারছে না। আমি বলতে থাকি তোর তো গলিপথ তো চেনা-যেকোনোভাবেই দৌড় দে। কিন্তু সে চেষ্টা করেও পারেনি। এক পর্যায়ে রাত ১টা ৫৮ মিনিটে আমার সঙ্গে শাহেদের সর্বশেষ কথা হয়। তখন সে বলে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এরপর সে কালেমা পড়তে পড়তে নিথর হয়ে যায়। পরে বারবার ফোন দিলেও তাই আর ফোন ধরতে পারেনি।’

রাত পৌনে তিনটার দিকে শহরে এসে পৌঁছান সাজ্জাদ মিয়া। এসেই শাহেদকে উদ্ধার করতে একাই উঠে পড়েন রিয়াজউদ্দিন বাজারের রিজওয়ান প্লাজার সেই পাঁচ তলার বাসায়। অন্ধকার আর ধোঁয়ার মধ্যেই শাহেদকে উদ্ধার করতে ঢুকে পড়েন বাসায়। পরে টয়লেটে গিয়ে দেখেন-সেখানে নিথর হয়ে পড়ে আছেন শাহেদ।

সাজ্জাদা মিয়া বলেন, আমরা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিয়েছি। কিন্তু সড়ক সরু হওয়ায় কথা জানিয়ে তাঁরা জানান প্রবেশ করতে পারছেন না। এ কারণে তারা দ্রুত মার্কেটের ওপরও উঠতে পারেননি। পরে আমি অন্যদের খবর দিলে পাশের ভবনের কয়েকজন রিজওয়ান কমপ্লেক্সের আটতলার ছাদ দিয়ে ঢুকে নিচে নেমে শাহেদকে উদ্ধার করেন। পরে আমরা তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসি। কিন্তু চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন-শাহেদ আর বেঁচে নেই।’

রিজওয়ান কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় সাজ্জাদ মিয়ার মোবাইল ও মোবাইল যন্ত্রাংশের দোকান রয়েছে। আজওয়ার টেলিকম নামের সেই দোকানে দেড় বছর ধরে চাকরি করতেন শাহেদ। রিয়াজউদ্দিন বাজারের বেশিরভাগ মার্কেট ৭-৮ তলা হলেও দোকান এক থেকে তিন তলা পর্যন্ত। এর ওপরের ঘরগুলোতে দোকানের মালিক-কর্মচারীরা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। কিছু কিছু ঘর ব্যবহার হতো গোডাউন হিসেবে। সে অনুযায়ী রিজওয়ান প্লাজার পাঁচতলায় বাসা নিয়ে ভাড়া থাকতেন সাজ্জাদ মিয়া ও শাহেদ। প্রতিদিন দোকান বন্ধের পর এখানেই থাকতেন তাঁরা। তবে শুক্রবার মার্কেট বন্ধ থাকায় তাঁরা প্রায় সময়েই বৃহস্পতিবার রাতেই সাতকানিয়ার গ্রামের বাড়িতে চলে যেতেন। এবার দোকানের মালিক সাজ্জাদ মিয়া বাড়িতে গেলেও যাননি শাহেদ। তবে আজই হয়তো বাড়ি পৌঁছবেন শাহেদ! তবে বাড়ি ফেরার সেই হাসিমুখে নয়, বাড়ি যাবে তার কফিনবন্দী দেহ।

সর্বশেষ সংবাদ