হাবীব আরাফাত, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের ৫ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে এই অঞ্চলের আশেপাশে বয়ে যাওয়া শঙ্খ নদী, ডলু নদী ও হাঙর নদীতে ধারণ ক্ষমতার বেশি পানি প্রবাহিত হওয়ায় তীর ভেঙে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এতে প্লাবিত হয়েছে সাতকানিয়া, লোহাগড়া, চন্দনাইশ ও বাঁশখালী সহ অন্তত ৫ টি উপজেলা। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা। এরমধ্যে লোহাগাড়া বন্যার পানিতে তলিয়ে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার বিকেল পাঁচটা থেকে নিখোঁজ রয়েছেন এক কৃষক। স্থানীয়দের দাবি গত তহন দশকেও এমন বন্যা দেখেনি দক্ষিণ চট্টগ্রাম। আকস্মিক এমন বন্যার জন্য চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন তৈরিকে দোষছেন তারা। তাদের দাবি, নবনির্মিত এই রেললাইন দক্ষিণ চট্টগ্রামের জন্য গলার কাটা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রেললাইনে তৈরির ফলে এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি উপজেলার মাঝামাঝি কৃত্রিম বাঁধের সৃষ্টি হয়েছে। আর তাতে বিঘ্ন ঘটছে পানি প্রবাহের।
বিষয়টি নিয়ে সোমবার রাত থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সরব হয়েছেন ওই অঞ্চলের অনেক বাসিন্দা। মিনহাজুল ইসলাম নামের একজন ফেসবুকে ক্ষোভ জেড়েছেন এভাবে, ‘এ বছর দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটা অংশ পানির নিচে চলে যাচ্ছে রেললাইনের কারণে। কেন, কিছু কালভার্ট নির্মাণ করে দিলে কি হতো? শত শত কোটি টাকার রেললাইন নির্মাণ করা যায় সামান্য কয়েকটা কালভার্ট নির্মাণ করে দিলে কি হতো!’
লোহাগাড়ার আমিরাবাদ এলাকার নূর উদ্দিন লিখেন, ‘কিছু ভুলের কারণেই দুদিন ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের অনেক গ্রাম প্লাবিত। চট্টগ্রাম – কক্সবাজার রেললাইনের মাঝে অল্প সংখ্যক কালভার্ট ও সাঁকোর ফলে অতিরিক্ত পানি একপাশ থেকে অন্যপাশে পারাপার করতে না পারার ফলেই বন্যা। কতৃপক্ষের উচিত এটির জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া।’
সাতকানিয়ার কাঞ্চনাবাদ এলাকার কাজী মো. বাদশা লিখেছেন, ‘অপরিকল্পিত রেললাইনের কারণে আজ দোহাজারী,সাতকানিয়া, লোহাগড়া বন্যাকবলিত।’
অনেকটা একই মত লোহাগাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান জিয়া উদ্দিন চৌধুরী বাবুলেরও। তিনি বলেন, ‘রেললাইনের কারণে পানি যেতে পারতেছে না- এটার কিছুটা সত্যতা আছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ কালভার্ট দেওয়ার দরকার ছিল। এত বছর কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না, এবছর রেললাইনের কারণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। এখন বোঝা যাবে কোন কোন এলাকায় আরো কালভার্ট দিতে হবে। এটা জেনে নিয়ে সংশোধন করা দরকার।’
রেললাইনকে বন্যার একমাত্র কারণ হিসেবে মানতে নারাজ সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এম. এ মোতালেব। তার মতে গেল তিন দশকে এবার সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হলেও এর সবচেয়ে বড় কারণ অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও ওই অঞ্চলের নদীগুলোতে ধারণক্ষমতার বেশি পানি প্রবাহ। তবে রেললাইনকে দায়ি করার বিষয়টিও খুব বেশি অযৌক্তিক নয় বলে মত তার। তিনি বলেন, ‘বন্যার কারণ হিসেবে রেললাইনকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ দায়ি করা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ অতিবৃষ্টি। আমি পুরো জীবনেও এৃন বৃষ্টি দেখিনি। পাশ্ববর্তী হাঙর নদী, ডলু নদী ও শঙ্খতে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি পানি প্রবাহিত হওয়ায় নদী তীর ভেঙে পানি লোকালয়ে চলে এসেছে। তাই এই বন্যাটা হয়েছে।’
রেললাইনের কারণে বন্যার বিষয়টি সঠিক নয় বলে দাবি প্রকল্পটির পরিচালক মফিজুর রহমানের। তিনি বলেন, ‘রেললাইনের দুপাশে কিন্তু পানি সমান। দুপাশে পানি সমান থাকা মানে প্রয়োজনীয় কালভার্ট রয়েছে। রেললাইনের কারণে এক পাশের পানি আটকাতে পারে, উভয় পাশের পানি তো আর আটকাবে না৷ মূলত পানি প্রবাহের চেয়ে বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। তাই পানি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে সারতেছে না। বৃষ্টি বন্ধ হলে পানি থাকবে না।’
বন্যার কারণে কিছু কিছু জায়গায় নবনির্মিত এই রেললাইনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তবে নবনির্মিত রেললাইন বন্যার একটা কারণ হলেও এর পেছনে আরো কিছু কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন চুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আসিফুল হক। তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে যেন জলাধারে সড়ক নির্মাণের সময় ফ্লাইওভারের মত করে নির্মাণ করা হয়। এতে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকবে। আসলেই এটা, যতবেশি কালভার্ট, পানি প্রবাহ তত স্বাভাবিক। তাতে সড়ক বা অন্য কোনো স্থাপনাও ঠিক থাকবে। তবে স্টাডি না করে এটাকেই একমাত্র কারণ বলা যাবে না। আরো অনেক কারণ থাকতে পারে।’
জলাধার ভরাট, নদীর গভীরতা হ্রাসও এই বন্যার অন্যতম কারণ হতে পারে বলে জানান এই অধ্যাপক।
এদিকে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত সাতকানিয়ায় বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে বলে জানান সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এম. এ মোতালেব। সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বন্যা কবলিত এলাকা। সোমবার থেকে বিদ্যুৎ বন্ধ থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো ভেঙে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন অপারেটরের মোবাইল নেটওয়ার্কও। হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতিতে হিমসিম খাচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবাই। পানির স্রোত থাকায় ব্যবহার করা যাচ্ছেনা ইঞ্জিনবিহীন নৌকা।
সাতকানিয়ায় উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন এলাকার বহুতল স্কুল ভবন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। উপজেলার তুলনামূলক উঁচু এলাকা উপজেলা পরিষদ ও কেরানিহাটে কোমর পানি হওয়ায় পুরো সাতকানিয়া পানিতে ডুবে গেছে বলে ধারণা করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন বিশ্বাস।
তিনি বলেন, ‘আমার অফিসের সামনে এক কোমর পানি, কেরানিহাটেও পানি অনেক। এগুলো ডুবেগেছে, তাই ধারণা করা হচ্ছে পুরো সাতকানিয়া ডুবে গেছে। গতকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল নেটওয়ার্কও বন্ধ। সড়ক যোগাযোগ তো বন্ধই। তাই সমন্বয় করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’
সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় নানা কারনে উপজেলার বাইরে বসবাসকারীরা বাড়িতে থাকা স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। সাতকানিয়া পৌরসভার ভোয়ালিয়া পাড়ার ফজিলাতুন্নেছা চৌধুরী বৃষ্টি পড়াশোনার জন্য চট্টগ্রাম শহরে থাকেন। তিনি বলেন, ‘গতকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই, বাড়িতে পানি ঢুকেছে বলেছিল। আমার বাবা আর ভাই আছে সেখানে, কিন্তু এখন আর কোনো যোগাযোগ করে পারছিনা।’
উপজেলার কাঞ্চনা এলাকার বাসিন্দা মো. ওমর ফারুক আজম বলেন, ‘আমি চাকরীর জন্য শহরে থাকি। কিন্তু বাড়ির পাশে ডলু ও শঙ্খ নাদী ভেঙে এলাকায় পানি ঢুকেছে। গতকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল নেটওয়ার্কও নেই। কোনোভাবেই বাড়িতে যোগাযোগ করতে পারতেছি না।’
সাতকানিয়ার পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দুই উপজেলা চন্দনাইশ ও লোহাগাড়াও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চন্দনাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মহাসড়কে ছোট ও মাঝারি যান চলতে পারছে না। পাঠানিপুল এলাকায় পানি বেশি, কিছু গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে৷ একটা একটা গাড়ি পার হচ্ছে। এলাকার নিচু অঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে।’
এএইচ/এসএম