বছর তিনেক আগে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনার প্রকোপ কমলেও তার রেশ রয়ে গেছে এখানো। শুরুর দিকে লকডাউনে ছিল পুরো পৃথিবী। স্তব্ধ ছিল বাংলাদেশও। করোনার সেই লকডাউনে বেশ লম্বা সময় ধরে বন্ধ ছিল প্রায় সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্ধের সেই সময় গৃহবন্দী হয়ে বিরক্তিকর সময় পার করেছিল শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ ঝুঁকেছে ভার্চুয়াল জগতের দিকে, কেউ মজেছে নানা ধরণের গেমসে। আবার কেউ কেউ এই সময়টা কাজে লাগিয়ে শিখে নিয়েছে নতুন কিছু। তাদেরই একজন প্রিয়াংশু রায় চৌধুরী। লকডাউনের বন্ধে ১২০ টিরও অধিক দেশের জাতীয় সংগীত রপ্ত করেছে সে। তার আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা করেছেন হাবিব আরাফাত।
শুরুটা প্রিয় ক্রিকেট দলকে দিয়ে
পড়াশোনার চাপে খেলাধূলা দেখার খুব একটা সুযোগ না হলেও প্রিয় দলের খেলা কখনোই মিস দেন না প্রিয়াংশু। অন্য দশজন বাংলাদেশীর মত ক্রিকেটে প্রিয়াংশুর সবচেয়ে পছন্দের দল টাইগার্স। এর পর অষ্ট্রেলিয়ার খেলা দারুণ লাগে তার। তাই দেশের খেলার পাশাপাশি মিস দেননা অস্ট্রেলিয়া দলের খেলাও। একদিন খেলার শুরুতে জাতীয় অস্ট্রেলিয়া দল জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় তার মনে হলো, ‘দেশের জাতীয় সংগীত তো জানি, অস্ট্রেলিয়ারটাও শিখতে পারলে কেমন হয়?’ যেই ভাবা সেই কাজ, দিন দুয়েকের মধ্যেই শিখে নিলেন অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীত। তারপর মনে হলো, ‘অস্ট্রেলিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ নিউজিল্যান্ডের জাতীয় সংগীতটাও তো শেখা যেতে পারে।’ শিখে নিলেন সেটাও। এভাবে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে আগস্টের মধ্যে মাত্র ৫ মাসে একে একে শিখে নিলেন ৮০ টি দেশের জাতীয় সংগীত।
মা সঙ্গ দিলেও শুরুতে গুরুত্ব দেননি বাবা
শুরুর দিকে নগরীর সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুল এন্ড কলেজ নবম শ্রেণিতে পড়তেন প্রিয়াংশু। এখন অবশ্য স্কুল বদলেছে, এখন পড়েন সরকারী মুসলিম হাইস্কুলে। কদিন পরই বসবেন মাধ্যমিক পরীক্ষায়। বাবা সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় করোনায় ছেলেকে খুব একটা সময় দিতে পারতেন না। তবে প্রিয়াংসুর মা গৃহিণী হওয়ার সুবাদে তিনি শুরু থেকেই তার বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংগীত শেখাটা খেয়াল করেছেন। এদিকে মায়ের কাছে ছেলের এই বিষয়টা জানতে পেরে পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছে ভেবে প্রিয়াংশুকে বকা দেন বাবা। তবে তিনিও খুব দ্রুত বিষয়টা বুঝতে পারেন। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে ছেলের মুখে বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংগীত শুনে এক সময় মুগ্ধ হতে শুরু করেন বাবাও।
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের চিন্তা
প্রিয়াংশু এক সময় চিন্তা করলেন, ‘আরে, এটা তো একটা ওয়াল্ড রেকর্ডও হতে পারে।’ গুগল করে জেনে নেন এরকম রেকর্ড আগে কেউ করেছে কিনা। এতে তিনি জানতে পারেন কানাডার কেপ্রি এভেরিটের কথা। যিনি কিনা বিশ্বের ৭৬ টি দেশে গিয়ে সেসব দেশের জাতীয় সংগীত গেয়ে বিশ্ব রেকর্ড করে গিনেস ওয়াল্ড রেকর্ডস বুকে নাম লেখিয়েছেন। কেপ্রির রেকর্ড ভাঙতে চান প্রিয়াংশু। তার চেয়ে বেশি দেশের জাতীয় সংগীত গেয়ে কেপ্রির জায়গায় নিজের নাম বসাতে চান তিনি। ইতোমধ্যে এর জন্য গিনেস ওয়ার্ড রেকর্ডস বুক কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদনও করেছেন তিনি। তবে প্রতিটি দেশে গিয়ে গিয়ে সেসব দেশের জাতীয় গাইতে হলে প্রয়োজন প্রচুর অর্থের, সেসব নিয়ে কিছুটা চিন্তিতও সে।
গান ভালো লাগে ছোট থেকেই
প্রিয়াংশুর গানের হাতেখড়ি হয় মায়ের হাতেই। তবলা বাজাতে দারুণ লাগে তার। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংগীত শেখার পাশাপাশি ইউটিউব দেখে ইউকুলেল বাজানোও শিখে নিয়েছেন তিনি। মায়েরকাছে হাতেখড়ির পর ছোট থেকেই গান করতে ভালো লাগে তার। মোটামুটি সব ধরণের গান করা হলেও সবচেয়ে ভালো লাগে রবীন্দ্র সংগীত।
দেশে ক্রিকেট খেলতে আসা দলের জাতীয় সংগীত গাওয়ার ইচ্ছা
দেশে বিভিন্ন সময় ক্রিকেট খেলতে আসে বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়রা। সাধারণত বিদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়ার জন্য শিল্পী থাকে, কিন্তু বাংলাদেশে এরকম কোনো শিল্গী থাকে না। প্রিয়াংশু চান দেশের জাতীয় সংগীত গাওয়ার পাশাপাশি সফরকারী কোনো দলের জাতীয় সংগীত গাইতে। এতে ভিনদেশীদের কাছে বাংলাদেশের প্রতি একটি ইতিবাচকতা তৈরি হবে বলে বিশ্বাস তার।
১২০ পেরিয়ে কত?
প্রিয়াংশু বলেন, ‘বর্তমানে ১২০ টি দেশের জাতীয় সংগীত গাইতে পারি আমি। নতুন করে আরো শিখছি। তবে পৃথীবির সব দেশের জাতীয় সংগীত শেখার ইচ্ছে নেই আপাতত। আর যে কয়টা পারি শিখবো।’
বাবা মায়ের চাওয়া ভালো মানুষ:
বিজ্ঞানের ছাত্র প্রিয়াংশু, বড় হয়ে বিজ্ঞান নিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান। তবে বাবার চাওয়া যা ই হোক না কেন, সবার আগে যেন ভালো মানুষ হয় প্রিয়াংশু। তার বাবা পলাশ রায় চৌধুরী বলেন, ‘শুরুতে ওর বিষয়টা না বুঝে বকাবকি করেছিলাম। এর জন্য পরে নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছিল। ও লকডাউনে গেমসে আসক্ত বা ভার্চুয়াল জগতে আসক্ত না হয়ে এতগুলো দেশের জাতীয় সংগীত শিখেছে- এটা সৃষ্টিশীল। বাবা হিসেবে তাকে নিয়ে গর্ব করার মত বিষয়। সে যেন সবার আগে ভালো একজন মানুষ হতে পারে।’
প্রিয়াংশুর মা সোমা দত্ত বলেন, ‘শুরুতে ভেবেছিলাম পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছে, পরে দেখি এগুলো শিখছে। ওর ইচ্ছে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বুকে নাম লেখানোর, সেটা যেন পুরণ হয়।’
আজকের সারাদশ/১৫ এপ্রিল ২৩/এএইচ