রাত ২:৩৭, মঙ্গলবার, ২রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইতিহাসের পাতায় জব্বারের বলীখেলা

বিশেষ ফিচার:

চট্টগ্রাম বলির দেশ। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মগ্ন উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মন্ত্ররা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মহাবীরেরাই ছিলেন বলিখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলিখেলা আয়োজনের মূল অনুপ্রেরণা চট্টগ্রামের বাইশটি মগ্ন পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ।

আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, ছাতরি গ্রামের চিকন মগ্ন, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মগ্ন, জিরি গ্রামের ঈদ মা ও নওয়াব ময়া, পারি গ্রামের ছবি মা, পেরলা গ্রামের নানু মা পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোৱাহিত মগ্ন, হাইদগাঁওর অগ্নি মগ্ন ও মোজাহিন মগ্ন, শোভনদন্ডীর তোরা মল্ল, কাঞ্চননগরের আলম মল্ল, ঈশ্বরবাইনের গনি মা, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মা, শিতাপচরের পিতাপ বা ইমামচরের ইমাম মলল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন না, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল।

ভারতবর্গের স্বাধীন নবাব টিপু সুলতানের পতনের পর এই দেশে বৃটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে স্থান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন।

আমরা একটু বলী খেলার পেছনের ইতিহাস জেনে নিই, বলী খেলার শ্রেষ্ঠ সময় ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত। সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে চৈত্র থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত আয়োজন করা হতো বলীখেলা। তখন এই অঞ্চলের অনেকেই ছিলেন ইয়াংগুন তথ্য মিয়ানমার প্রবাসী। তাঁদের বলা হতো রেডাইন্যা। রেইডডইন্যাদের হাতে ছিল প্রচুর অর্থ। তারাই পৃষ্ঠপোষকতা করত বলীখেলার। পরে অন্য অনেকেই এ খেলা আয়োজনে এগিয়ে আসেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজল বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে বলীখেলার আয়োজন করতেন।

পাকিস্তান আমলের মন্ত্রী একে খানও যৌবনে বলী খেলতেন বলে জানা যায়। ঢাকার নবাব আবদুল গণিও ছিলেন বলী খেলার পৃষ্ঠপোষক।

আঞ্চলিকতার একটি টান রয়েছে এ খেলায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম জেলা ও বিভাগের বাদীরাই বাহুবল, গায়ের জোর ও কৌশলের মধ্য দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার চেষ্টা চালান। এ খেলাকে ঘিরে এক সময় চট্টগ্রামের আঞ্চলিকতা থাকলেও বর্তমানে দেশব্যাপী এ বলী খেলার প্রচার থাকায় বিভিন্ন এলাকা থেকেও নদীরা এতে অংশ নেন। বর্তমানে চট্টগ্রামের মানুষের সবচেয়ে বড় উৎসব এটি। আয়োজনটি নগরবাসীকে বিরাট আনন্দের উপলক্ষ এনে দেয়। বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই শহরের সর্বত্র শুরু হয়ে যায় বলী খেলার আলোচনা। সব ক’টি স্থানীয় পত্রিকার গুরুত্বসহকারে খবর প্রকাশিত হয়। থাকে বর্ণীদের নানা খোঁজখবরও আজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লালদীঘি ময়দানে জড়ো হতে থাকবে বলীরা। সকলেই খুব সুঠাম দেহের অধিকারী হবেও এমন নয়। প্রতিবছরই এ দৃশ্যটি চোখে পড়ে। খেলোয়াড় হিসেবে যারা অংশ নিতে আসেন, তাদের অনেকে নিয়মিত খেলেন না। তবে প্রেমটি আছে। সে প্রেমই তাঁদের অনুপ্রেরণার উৎস।

এক সময় জব্বারের বলী খেলার মূল ক্ষণ ছিল ১০ বৈশাখ। আর বৈশাখের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ ছিল মেলার নির্ধারিত দিন। কিন্তু কালের বিবর্তনে ও ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য বৈশাখ মাসের বিভিন্ন সময়ে নগরীর বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী আয়োজন থাকার কারণে মেলা যেমন পিছিয়েছে, তেমনি প্রসারতা বেড়েছে। বর্তমানে ২৫ এপ্রিল বলী খেলার নির্ধারিত দিন। এ খেলা দিয়ে আগে-পরে প্রায় ১০ থেকে ১৫ দিন যাবত মেলা চলতে থাকে। সিএমপির পক্ষ থেকে ৩ দিন মেলার অনুমতি দেয়া হলেও দূরদূরান্ত থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কুটির শিল্পের আকর্ষণীয় পণা সামগ্রী ও তৈজসপত্র নিয়ে আসার কারণে মেলার সময় অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গ্রামীণ মেধায় গড়া সামগ্রির মধ্যে রয়েছে পুতুল, বাঁশি, মুখোশ, নৌকা, ফুলদানি, শীতল পার্টি, ব্যাগ, ঝাড়, হাতপাখা, তামা পিতল ও কাসার সামগ্রী, মেয়েদের চুড়ি বাঁশ ও কাঠের তৈরি গহনা, হাঁড়ি পাতিল, কলসি, কুলা, চালন, ছুরি, কাঁচিসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র এ মেলায় পাওয়া যায়।

আব্দুল জব্বার তুপ্তি প্রতিযোগিতা ও বৈশাখী মেলা কমিটির সাথে কথা বলে জানা যায়, বলী ধরার লড়াইয়ের জন্য বলীরা মাসখানেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে থাকে। জব্বারের বলী খেলায় চট্টগ্রামের বলীদের সংখ্যাই বেশি। তবে কক্সবাজার, টেকনাফ, রামু, উখিয়া, চকরিয়া, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালীসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার বলী খেলোয়াড়রা বলী খেলায় অংশ নিতে ছুটে আসেন।

জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলাকে ঘিরে লালদীঘি ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। পুলিশের পাশাপাশি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এবং গোয়েন্দা বিভাগ বৈশাখী মেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঠে সক্রিয় থাকেন।

জব্বারের বলী খেলাকে ঘিরে লালনীমি ময়দান ও আশপাশের প্রায় এক বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসে গ্রামীণ লোকজ মেলা। লালদীঘি ময়দান, জেল রোড এলাকা, টেরিবাজার, হাজারী লেইন, আন্দরকিল্লা, কেসি দে রোড, সিনেমা প্যালেস মোড়, কোতোয়ালী মোড়সহ আশপাশের এলাকায় বসে ঢাক-ঢোল, মণ্ডামিঠাই, শীতল পাটি, হাতপাখা, ফুলের ঝাড়ু, মাটির তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী, রেশমী চুড়িসহ বিভিন্ন পণ্যের সারি সারি দোকান। ময়দানের আরেক পাশে চলে সার্কাস ও নাগরদোলা। এ যেন নিয়ে যায় বাঙালির ঘাট বাংলার ঐতিহ্য।

আজকের সারাদেশ/২৫ এপ্রিল ২৩/জেএম

সর্বশেষ সংবাদ

কবিতা: স্বাধীনতা।

ভূমি, কার্গো দখল ও ঘর ভাংচুরের ঘটনায় কবিরহাট থানায় মামলা

চবিতে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের ‘মুক্ত সংলাপ’ প্রত্যাখান শিক্ষার্থীদের, ষড়যন্ত্র না করতে দিল হুঁশিয়ারি

১৫ বছর পর মাতৃভূমিতে যুবদল নেতা হাসান নূরী

চবি উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক শামীম অথবা ড. আতিয়ারকে চান শিক্ষার্থীরা

ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হওয়ার দায় নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইলেন পলক

কোপা আমেরিকার সেরা একাদশে ৫ জনই আর্জেন্টিনার, ব্রাজিলের এক

গুলিবিদ্ধ কিশোরকে রিকশায় তুলতে গিয়ে দেখলেন নিজেরই সন্তান

নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করবে চবি কর্তৃপক্ষ

১২ দিন পর স্বল্প পরিসরে ট্রেন সার্ভিস চালু