হাবীব আরাফাত, চট্টগ্রাম
দুদকের সাবেক কর্মকর্তা ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লা স্ত্রীর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমিতে ভবন নির্মাণের কাজ করছিলেন। সেখান থেকে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের চেষ্টা করেন স্থানীয় কথিত রাজনৈতিক নেতা মো. জসিম উদ্দিন। ব্যর্থ হয়ে চাঁদা আদায়ের শেষ চেষ্টা হিসেবে গায়েবি মামলা দিয়ে হয়রানির চেষ্টা করেন। নগরীর কল্পলোক আবাসিক এলাকার এক গৃহবধূকে শহিদুল্লাহর গৃহকর্মী সাজিয়ে ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম ৬ষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরিফুল ইসলামের আদালতে মামলা দায়ের করেন। ২৭ সেপ্টেম্বর সেই মামলায় শহিদুল্লাহর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এর ৪ দিন পর থানায় পৌঁছে পরোয়ানাটি। সেই পরোয়ানা মূলে মঙ্গলবার রাতে শহিদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে চান্দগাঁও থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারের কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। শুরু থেকে তার পরিবারের অভিযোগ গ্রেপ্তারের পর নিহত শহিদুল্লাহর কাছে ওষুধ ও ইনহেলার পৌঁছাতে দেয়নি পুলিশ। তাই তাঁর মৃত্যুকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হিসেবেই দেখছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিহত সাবেক দুদক কর্মকর্তা ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লা ও তার শ্যালক মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ারকে আসামি করে ওই মামলা দায়ের করেছেন রণি আক্তার তানিয়া নামের এক নারী। নিজেকে শহিদুল্লাহর গৃহকর্মী দাবি করে মামলার এজহারে পাওনা বেতনের সাড়ে ৬ হাজার টাকা চাইতে গেলে আসামিরা তাকে মারধর, হত্যাচেষ্টা, হুমকি ও তার শালীনতা ক্ষুন্নের চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ এনেছেন।
মামলায় ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লা ও তার শ্যালক মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ারকে আসামি করা হয়। গত ২৭ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। পরোয়ানাটি গত ১ অক্টোবর চান্দগাঁও থানায় পৌঁছায়।
তবে নিহতের পরিবারের বাদি, তাদের বাসায় গত দুই বছর পর্যন্ত কোনো গৃহকর্মী নেই৷ ২ বছর আগে মুক্তা নামের এক তরুণী ছিল, তার বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন তারা। এমনকি পরিবারের কেউই গৃহকর্মী দাবি করা রণি আক্তার তানিয়া নামের ওই নারীকে চেনেন না।
নিহত শহিদুল্লাহর স্বজনদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে রণি আক্তার তানিয়া নামের ওই নারীর পরিচয় জানার চেষ্টা করেছে দৈনিকবাংলা। মামলার এজহারে উল্লেখ করা মুঠোফোন নম্বরের সূত্র ধরে ওই নারী ও তার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। শুরুতে মুখ না খুললেও পরবর্তীতে জসিম নামের এক কথিত রাজনৈতিক নেতা ও তার আইনজীবী সাদেক উদ্দিনের প্ররোচনায় নিজেকে শহিদুল্লাহর গৃহকর্মী দাবি করে মামলাটি দায়ের করার কথা জানান রণি আক্তার।
অভিযুক্ত জসিম উদ্দিন রাউজানের গৈয়া মোহাম্মদের বাড়ি এলাকার শামসুল আলমের ছেলে। বর্তমান চান্দগাঁও থানার এক কিলোমিটার এলাকায় বসবাস তার। নিজেকে এলাকায় যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিলেও তাঁর কোনো পদ-পদবি নেই।
রণি আক্তার দৈনিকবাংলাকে জানান, ঘটনার শুরু মাস দুয়েক আগে। তিনি সন্তানসহ তিন চাকার ছোট্ট গণপরিবহন ম্যাক্সিমা চালক স্বমী মো. সোহেলের সঙ্গে নগরীর বাকলিয়া থানার কল্পলোক আবাসিক এলাকায় বসবাস করতেন। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধগতির কারণে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। এরমধ্যে সোহেল এক বন্ধুর মাধ্যমে চাদগাঁও থানার এক কিলোমিটার এলাকায় বিনা ভাড়ায় একটি বাসায় বসবাসের প্রস্তাব পায়। এর বাইরেও বাসার মালিক প্রতিমাসে তাদের কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে দেওয়ার কথাও জানানো হয়।
তাদের বিনামূল্যে থাকার জন্য নির্ধারিত বাসাটি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা জসিমের বলে জানতে পারেন তখন।
এর প্রেক্ষিতে আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে ওই বাসায় প্রবেশ করেন তারা। ওইদিন দুপুরেই পুলিশ এসে তাদের নাম ঠিকানা লিখে নিয়ে যায়। পুলিশ আসায় দুজনেই ভয় পেয়ে যান। বাসায় কোনো সমস্যা আছে ভেবে পরদিন সকালেই বাসাটি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এরমধ্যে ওইদিন সন্ধ্যায় স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। চারদিন কারাগারে থাকার পর তাদের জামিনে মুক্ত করেন জসীম। কিন্তু বাসায় গিয়ে দেখেন দুটো খাটসহ অন্যান্য আসবাবপত্র ও সামগ্রী লুট হয়ে গেছে৷ বিষয়টা জসীমকে জানালে তিনি দুটো বিছানাপত্র ও চারটা পাতিল কিনে দেন তাদের। এরমধ্যে তারা জানতে পারেন তাদের জিনিসপত্র মূলত বাসার পার্শ্ববর্তী শহিদুল্লাহ নামের একজনের স্ত্রী নিয়ে গেছেন। শহিদুল্লাহ বাসায় ওই জিনিসপত্রের জন্য তানিয়ার স্বজনরা গেলে খারাপ ব্যবহার করেন তার স্ত্রী।
পরবর্তীতে একবার আদালতে হাজিরা দিতে গেলে জসিম তাদের ৫০০ টাকা গাড়িভাড়া হিসেবে দেন।
রণি আক্তার তানিয়া বলেন, ‘খরচ কমিয়ে সুখে দুটা ডালভাত খাওয়ার জন্য ওই বাসায় উঠেছিলাম। কিন্তু উল্টো আমার সব জিনিসপত্র হারালাম। জসিম আমার জিনিসপত্র নিয়ে দিবে বলছে, তারে ফোন করলে ঝাড়ি দেয়, রিসিভ করে না। এরপর একদিন সে বললো শহিদুল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা করতে। আমরা রাজি হল না হওয়ায় সে বলছে মামলা না করলে জিনিসপত্র ফিরে পাব না। এরমধ্যে একদিন জসিম ও তার আইনজীবী আদালতে ডেকে মামলা করার কথা জানায় আমাদের। সেখানে যা যা লিখছে ২০ থেকে ২৫ মিনিট ধরে আমাকে মুখস্থ করাইছে। পরে বিচারকের সামনে গিয়ে দাড়াইছি, আমার কাছ থেকে সাইন নিছে। আর কিছু করতে হয়নি।’
পরবর্তীতে কয়েকদিন আগে ফের জসিমের সহযোগী লিটন ও আইনজীবী সাদেক তাদের ফোন করে আদালতে যেতে বললেও এখনোও লুট হওয়া জিনিসপত্র না পাওয়ায় রাগ করে আর যাননি বলে জানান তিনি।
রণি আক্তার আরো বলেন, “আজ সকালে আমাকে লিটন ফোন করে বলছে শহিদুল্লাহকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর মরে গেছে। আমি যেন মোবাইলের সীম বন্ধ করে বাড়িতে (বাঁশখালী) চলে যাই৷ আমি বলছি, ‘না, আমি কেন এটা করব? আমার জিনিস তো পাইনি। আমার দোষ নাই। আমি কোথাও যাব না।’ এটা বলার পর সে বলছে তাহলে আমাদের সমস্যা হলে তাদের দোষ নাই।”
‘আমি সত্যটা বলে দিছি সবাইকে। শহিদুল্লাহ সম্পর্কে আমি জানতাম না। সবাই বলতেছে উনি অনেক ভালো লোক, নিরীহ।’
জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শহিদুল্লাহর বাসায় আমি কখনে যাইনি। তবে প্রথমবার আমাদের যখন ধরে নিয়ে গেছে তখন আদালতে দেখেছি। আমার স্বামী কখনো দেখেনি।’
নিহত শহিদুল্লাহর ছেলে ক্যাপ্টেন নাফিস শহিদ বলেন, ‘আমরা মায়ের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিতে ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। মূলত জসিম তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে আমার বাবার কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিল, আমরা রিফিউজ করেছি। কেন তাকে টাকা দিব? এজন্য সে আমাদের বাহির থেকে লোক বসিয়ে দিয়ে বাসা দখলের চেষ্টা করেছিল। শুরুতে কিছু মেয়েকে বাসায় নিয়ে এসেছিল। আমাদের মারামারি যাওয়ার মানসিকতা নেই, তাই থানায় অভিযোগ করেছিলা। আর বাসায় দখলকারীর যে মালামাল তার কিছু অংশ জসিমের সহযোগী আরেক জসিমের বোন নিয়ে গেছে। খাটসহ কিছুকিছু আমাদের বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে, এখনে নিচে পড়ে আছে।’
‘তবে ওই মহিলাকে আমরা কেউ চিনতাম না। এই নামের কারো নামই কখনো শুনিনি আমরা কেউই। আমরা পুরো বিষয়টার সুষ্ঠু তদন্ত চাই।’
এই বিষয়ে অভিযুক্ত জসিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে চাঁদা দাবি ও ওই গৃহবধূকে গৃহকর্মী সাজিয়ে মামলা দায়েরের বিষয় মিথ্যা দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে উনার কখনো দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। আমি এসএম জসিম নামের একজনের কাছ থেকে একটা জমির পাওয়ার নিয়েছিলাম, টাকা দিয়ে৷ এটা নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছে৷ উনি যে দুদকের কর্মকর্তা আমি আগে জানতাম না। রণি আক্তার তানিয়া নামের ওই নারীকে আমি চিনি না। আমি কেন তাকে দিয়ে মামলা করাব? আমার গাড়ির ব্যবসা আছে, আমি ওটাতেই ব্যস্ত।’
তবে জসিমের সহযোগী লিটন ও আইনজীবী সাদেক উদ্দিনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগোর চেষ্টা করেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।
এভাবে একজন নিরপরাধ মানুষকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর বিষয়ে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘সাধারণত বাদি সাইন করলে তার দায় বাদীটলর হয়ে যায়। তবে বাদী যদি অভিযোগ করেন যে তিনি যা বলেননি তা এজহারে লিখেছেন আইনজীবী, সেক্ষেত্রে আইনজীবী সমিতি ব্যবস্থা নিতে পারবে।’#
শহিদুল্লাহকে গ্রেপ্তারকারী দুই এএসআই প্রত্যাহার:
এদিকে শহিদুল্লাহকে গ্রেপ্তারকারী পুলিশের দুই সহকারী উপপরিদর্শককে প্রত্যাহার করা হয়েছে৷ থানা থেকে প্রত্যাহার করে তাদের পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে।
ওই দুই পুলিশ সদস্য হলেন চান্দগাঁও থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. ইউছুপ আলী ও এটিএম সোহেল রানা।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (প্রশাসন ও অর্থ) এম এ আসাদ সাক্ষরিত আদেশে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে প্রশাসনিক কারণে দামপাড়া পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
তদন্ত কমিটি:
পুলিশ হেফাজতে সাবেক দুদক কর্মকর্তার মৃত্যুর বিষয়টি তদন্তে বুধবার বিকেলেই ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) গণসংযোগ কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপ কমিশনার স্পীনা রানি প্রমাণিক জানান, নগর পুলিশের উপ কমিশনার (ডিসি উত্তর) মোঃ মোখলেছুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি-উত্তর) পংকজ দত্তকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। এছাড়াও নগর পুলিশের বিশেষ শাখার একজন সহকারি কমিশনারকে কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। দুদকের সাবেক উপপরিচালকের মৃত্যুর ঘটনায় নিয়ম বহির্ভূত কোন আচরন করা হয়েছে তা যাচাই করে কমিটিকে পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন নগর পুলিশের কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়।
নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা করছে পরিবার:
পুলিশ হেফাজতে দুদকের সাবেক উপপরিচালক ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লার মৃত্যুর ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে তার পরিবার। নিহতের ছেলে ক্যাপ্টেন নাফিস শহিদ বলেন, ‘আমরা অবশ্যই মামলা করব। আমরা আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
এর আগে মঙ্গলবার রাতে নগরীর চান্দগাঁও থানার এক কিলোমিটার এলাকার বাসার সামনে থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক উপ-পরিচালক ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর থানায় নেওয়া হলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে দাবি পুলিশের। পরবর্তীতে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে শুরু থেকেই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি স্বজনদের।
আজকের সারাদেশ/০৫অক্টোবর/এএইচ