আজকের সারাদেশ প্রতিবেদন
মাসে কোটি টাকা আয় করেও বছরের পর বছর সরকারের কর ফাঁকি দিয়েছিল চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন-চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স। সংবাদমাধ্যমে এ তথ্য ফাঁস হওয়ার পর চাপে পড়ে কর পরিশোধ করতে বাধ্য হয় এ ব্যবসায়ী সংগঠনটি।এবার চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি ওমর হাজ্জাজ তার চারটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর ফাঁকি দেওয়ার তথ্য মিলেছে। তিনি আয়কর ফাইলে তার চারটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তথ্য গোপন করেছেন।
গত বছরের ৭ নভেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের বঙ্গবন্ধু কনফারেন্স হলে আয়কর প্রদান সংক্রান্ত এক কর্মশালায় চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি ওমর হাজ্জাজ বলেছিলেন, ‘সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান খাত হচ্ছে আয়কর। কিন্তু আয়কর প্রদানের বিষয়ে অনেকেই সচেতন নয়।’ অথচ তিনি কর্পোরেট খাতে প্রতিনিধিত্বকারী ব্যবসায়ী সংগঠনের সভাপতি হয়ে সচেতনভাবে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তথ্য লুকিয়ে কর ফাঁকি দিয়ে আসছেন!
ওমর হাজ্জাজ যে চার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তথ্য লুকিয়েছেন সেগুলো হলো- ব্লু এনার্জি লিমিটেড, জিডি হার্বার সার্ভিস, গ্লোব ইঞ্জিনিয়ারিং শিপইয়ার্ড এবং রিলায়েন্স শিপইয়ার্ড। এর মধ্যে তিনি ব্লু এনার্জি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এছাড়া জিডি হার্বার সার্ভিস এবং গ্লোব ইঞ্জিনিয়ারিং শিপইয়ার্ডের ম্যানেজিং পার্টনার। আর রিলায়েন্স শিপইয়ার্ডের পরিচালক পদে আছেন।
গত বছরের ৮ আগস্ট বিনাভোটে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ওমর হাজ্জাজ। এ নিয়ে তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ওমর হাজ্জাজের এই চারটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য উল্লেখ করা হয়। তখন একটি জাতীয় দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি এই চার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা জানান।
কিন্তু তার কর ফাইলে এই চার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কোনো তথ্য নেই। কেবল রিলায়েন্স অ্যাসেটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টস (বিডি) ও চট্টগ্রাম আর্ট থিয়েটার লিমিটেড নামে দুটি প্রতিষ্ঠানে শেয়ার হোল্ডার পরিচালক হিসেবে বিনিয়োগের তথ্য উল্লেখ করেছেন।
ওমর হাজ্জাজ কর ফাইলে যে চারটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তথ্য গোপন করেছেন তার মধ্যে গ্লোব শিপইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নামে প্রতিষ্ঠানটির সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০১৬ সালে মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার চরকিশোরগঞ্জে ধলেশ্বরী নদীর তীরে গ্লোব শিপইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নামে জাহাজ মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়। ওমর হাজ্জাজ গ্লোব শিপইয়ার্ডের ম্যানেজিং পার্টনার। একটি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং পার্টনার সম্পত্তির অংশীদারিত্বের মালিক এবং সেই সাথে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বেও থাকেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গ্লোব শিপইয়ার্ডের জমির পরিমাণ হলো সাড়ে ৬ একর। এই জমির বর্তমান আনুমানিক বাজারমূল্য সাড়ে ৬ কোটি টাকা। তবে এই প্রতিষ্ঠানে ওমর হাজ্জাজের বিনিয়োগের পরিমাণ কত তা জানা যায়নি। এছাড়া বাকি তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তিনি কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন সে তথ্যও জানা যায়নি।
নিজের একটি প্রতিষ্ঠানের জমির মূল্য সাড়ে ৬ কোটি টাকা হলেও ওমর হাজ্জাজ সর্বশেষ ২০২৩-২৪ করবর্ষের আয়কর রিটার্নে ব্যবসায় মূলধনের পরিমাণ দেখিয়েছেন মাত্র ২৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৪৭ টাকা। এর মধ্যে তিনি দুটি প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স অ্যাসেটসে ২ লাখ এবং চট্টগ্রাম আর্ট থিয়েটারে ৫ হাজার টাকার শেয়ার রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
ওমর হাজ্জাজ আয়কর রিটার্নে মোট সম্পত্তির পরিমাণ দেখিয়েছেন ১ কোটি ৩৩ লাখ ৩২ হাজার ৪২৫ টাকা। আর বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ১৮ লাখ ১ হাজার ৯৪৬ টাকা। তার কোনো ব্যাংক ঋণও নেই বলে উল্লেখ করেছেন। তাহলে ২৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৪৭ টাকা ব্যবসায় পুঁজি খাটিয়ে গোপন করা সাড়ে ৬ কোটি টাকার গ্লোব শিপইয়ার্ডসহ চারটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হাজ্জাজের বিনিয়োগ করা অর্থের উৎস কী?
এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ওমর হাজ্জাজের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর বক্তব্য জানার জন্য খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি।
আয়কর আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈধ সম্পত্তি অর্জিত বছরে আয়কর রিটার্নে না দেখালে সেটা অনেকটা অবৈধ সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয়ে যায়, যেটাকে অপ্রদর্শিত সম্পত্তি বলা হয়। আর যে আয় করদাতা কর ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করে না, তা কালো টাকা বলে ধরে নেওয়া হয়। আয়কর রিটার্নে যে আয় দেখানো হয়, তার চেয়ে বেশি আয় বা অপ্রদর্শিত আয় পাওয়া গেলে তার ওপর জরিমানাসহ কর দিতে হয়। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে আয়কর ফাঁকি দিলে বা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সর্বোচ্চ ৫ বছর করাদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে নতুন আয়কর আইনে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-১ এর উপ-কর কমিশনার (সার্কেল-৬) এস এম নজরুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি যদি আয়কর রিটার্নে সম্পত্তির তথ্য গোপন করে থাকেন, তাহলে আমরা বিষয়টি তদন্ত করবো। তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ পেলে আমরা তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেবো।’
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নাজমুচ্ছায়াদাত বলেন, ‘চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতির সম্পত্তির তথ্য গোপনের বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে আমরা বিষয়টি আমলে নেবো। এরপর দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে যদি এ বিষয়ে অনুসন্ধানের নির্দেশ দেওয়া হয়, তাহলে আমরা অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পত্তির তথ্য অনুসন্ধান করবো। অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পত্তির প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’