আজকের সারাদেশ প্রতিবেদন
দেশে দীর্ঘদিন ধরে খনি থেকে কয়লা তোলার পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক চলছে। দিনাজপুরের ফুলবাড়ী খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা নিয়ে ২০০৬ সালে তৎকালীন এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে বড় ধরনের আন্দোলন হয়। এতে তিনজন নিহত হয়।
ওই সময় তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছয় দফা চুক্তি করেছিল। সেই চুক্তির মূল বিষয় ছিল ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা যাবে না। একই সময় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি হবে না। কৃষিজমির ক্ষতি করে কয়লা তোলা হবে না।
এখন ফুলবাড়ী কয়লাখনি উন্নয়নে সরকারের সঙ্গে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি জিসিএম রিসোর্স পিএলসির (সাবেক এশিয়া এনার্জি) সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই। বিষয়টি জানার পরও বিতর্কিত এই কোম্পানির হয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার তোড়জোড় শুরু করেছে চীনা কোম্পানি পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন চায়না।
এরই মধ্যে জিসিএমের সঙ্গে এ নিয়ে একটি চুক্তি করেছে ‘পাওয়ার চায়না’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত ওই কোম্পানি। এই চুক্তির মাধ্যমে পাওয়ার চায়না দিনাজপুরের আলোচিত ফুলবাড়ী কয়লাখনি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উন্নয়ন করবে। পাশাপাশি সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াটের বেশি ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশে এখনো এশিয়া এনার্জি করপোরেশন নামেই সক্রিয় রয়েছে জিসিএমের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি।
তা সত্ত্বেও শুরু থেকেই ফুলবাড়ী নিয়ে তৎপর ছিল এশিয়া এনার্জি। পরে কোম্পানিটির নাম পরিবর্তন করে জিসিএম রিসোর্সেস করা হয়। এই কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কয়লাখনি নিয়ে কোনো চুক্তি নেই। তবে বিভিন্ন সময়ে ফুলবাড়ী প্রকল্প নিয়ে তথ্য প্রকাশ করে লন্ডন শেয়ারবাজারে মূল্য প্রভাবিত করার অভিযোগ রয়েছে।
চলতি বছরের ১১ মার্চ জিসিএম রিসোর্সেস তাদের ওয়েবসাইটে ‘ফুলবাড়ী কোল মাইনিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ওভারবর্ডেন স্ট্রিপিং কনট্রাক্ট’ বিষয়ে একটি ঘোষণা দেয়। এতে উল্লেখ করা হয়, খনি উন্নয়নের জন্য জিসিএম রিসোর্স পাওয়ার চায়না ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ লিমিটেডের সঙ্গে ১ বিলিয়ন ইউএস ডলারের চুক্তি করেছে। তবে এই চুক্তির অগ্রগতি ‘উত্তরাঞ্চলে কয়লা অনুসন্ধান এবং উত্তোলন’ চুক্তির শর্তাবলির অধীনে বাংলাদেশ সরকারের কাছে জমা দেওয়া কয়লাখনির উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করছে। খনি নির্মাণ চুক্তির কার্য পরিধির মধ্যে রয়েছে খনি অবকাঠামোর নকশা, ক্রয়, ইনস্টলেশন, নির্মাণ এবং কমিশনিং এবং অতিরিক্ত মাটি, বালু ও পাথরের স্তর অপসারণ এবং পানি নিষ্কাশন।
জিসিএম জানায়, কয়লার প্রথম স্তর উন্মুক্তের জন্য মাটি, বালু ও পাথরের স্তর অপসারণ করতে প্রায় দুই বছর সময়সহ খনি নির্মাণ চুক্তির মেয়াদ চার বছর। তবে কয়লা উত্তোলন এবং উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি পরিচালনা করে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কমপক্ষে ৬ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা সরবরাহের জন্য জিসিএম এবং পাওয়ার চায়না অতিরিক্ত চুক্তি করার বিষয়ে আশাবাদী। এ বিষয়ে জিসিএম পাওয়ার চায়নার সঙ্গে একটি যৌথ প্রস্তাব শিগগির নবনির্বাচিত বাংলাদেশ সরকারের কাছে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
তবে জিসিএমের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কোনো চুক্তি নেই বলে নিশ্চিত করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘ফুলবাড়ী কয়লাখনি নিয়ে জিসিএমের সঙ্গে আমাদের কোনো চুক্তি নেই।’
তার পরও এই খনি নিয়ে লন্ডন শেয়ার মার্কেটে কীভাবে ব্যবসা করছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেটা আমরা বলতে পারব না। এ ছাড়া তারা কী করল, সেটা আমাদের দেখার বিষয়ও নয়। এটা নিয়ে আমরা কনসার্ন নই।’
বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কোনোরকম অনুমোদন না পেলেও পাওয়ার চায়নার সঙ্গে চুক্তিটি চলতি বছরের ৯ মার্চ থেকে কার্যকর করেছে জিসিএম। এজন্য পাওয়ার চায়না জিসিএমকে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এতে আরও বলা হয়, জিসিএম এরই মধ্যে ফুলবাড়ী কয়লাখনি থেকে কয়লা ক্রয়ের বিষয়ে চট্টগ্রাম ও বরিশালের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছ থেকে আগ্রহপত্র পেয়েছে। পরে ২৬ মার্চ জিসিএমের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে পাওয়ার চায়নাও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়।
ফুলবাড়ী নিয়ে চীনা কোম্পানির এ উদ্যোগকে ‘অপতৎপরতা’ আখ্যা দিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এশিয়া এনার্জি একটি বিতর্কিত কোম্পানি। খনি উন্নয়নে বিষয়ে কোম্পানিটির কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তার পরও ১৮ বছর ধরে লন্ডন শেয়ার মার্কেটে এই কয়লাখনি নিয়ে অবৈধভাবে ব্যবসা করছে জিসিএম।
তারা বলছে, সম্প্রতি দেশে কয়লাভিত্তিক বেশ কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে। এগুলো আমদানি করা কয়লা দিয়ে চালাতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বেড়ে যাওয়া এবং ডলার সংকটে আমদানি ব্যাহত হওয়ায় সম্প্রতি সরকারি পর্যায়ে দেশীয় কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি উত্তোলনের বিষয়ে গত মার্চে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী গণমাধ্যমে কথা বলার পরই চীনা কোম্পানি ও জিসিএম এ তৎপরতা শুরু করে।
তাদের মতে, চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের মতো বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের দোহাই দিয়ে বিতর্কিত ও ক্ষতিকর প্রকল্প বাস্তবায়নের নজির আছে, যা পরবর্তী সময়ে ওই দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে পাওয়ার চায়না আলোচিত ও বিতর্কিত ফুলবাড়ী কয়লাখনি নিয়ে একই সুযোগ নিতে চাইছে। যে কারণে সব জেনেও জিসিএমের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এ ছাড়া সরকারের মধ্যে জিসিএমের ও চীনা কোম্পানির এজেন্ট রয়েছে। তাদের দিয়েও সরকারকে প্রভাবিত করবে কোম্পানি দুটি।
জিসিএমের সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই জানিয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইন্স) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, ‘যেহেতু আমাদের সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই, তাই তারা কী করছে সেটা নিয়েও আমাদের কোনো আগ্রহ নেই।’
তবে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জিসিএমের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান এশিয়া এনার্জি করপোরেশনের আইনসম্মত চুক্তি রয়েছে বলে দাবি করেছেন কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গ্যারি এন লাই। হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো এক বার্তায় তিনি বলেন, ‘দেশের উত্তরাঞ্চলে কয়লা অনুসন্ধান ও খনি উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এশিয়া এনার্জি’র আইনসম্মত চুক্তি রয়েছে। সরকারের অনুমোদনে ফুলবাড়ীতে আন্তর্জাতিক মানের পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করে কোম্পানি খনি উন্নয়ন পরিকল্পনা সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। এ পরিকল্পনা সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে; অনুমোদনসাপেক্ষে খনি কার্যক্রম শুরু হবে।’
তবে জিসিএমের এমন দাবি প্রতারণাপূর্ণ উল্লেখ করে তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক সদস্য সচিব এবং অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘জিসিএম হচ্ছে জালিয়াতি করা বিশ্ব টাউটের একটা উদাহরণ। জিসিএম পাওয়ার চায়নার সঙ্গে চুক্তি করেছে তাদের পেশিশক্তি বাড়ানোর জন্য। পাওয়ার চায়না বাংলাদেশে বেশকিছু প্রকল্পে টাকা দিচ্ছে। এ ছাড়া পাওয়ার চায়নার সঙ্গে চুক্তি করে শেয়ার মার্কেটে জিসিএমের শেয়ার দাম বাড়াতে চাইছে। এ ছাড়া চীনা কোম্পানিগুলো অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য সারা বিশ্বে খ্যাত। তারা প্রকল্প পেতে যে কোনো ধরনের অনিয়ম করতে দ্বিধা করে না।’
তিনি বলেন, ‘এশিয়া এনার্জি (বর্তমানে জিসিএম) তারা ফুলবাড়ী নিয়ে ২০০৫ সাল থেকেই জালিয়াতির ব্যবসা করছে। এখন নাম পাল্টেছে। সরকারের মধ্যে তাদের লোকজনই আছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে জিসিএমর সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই, তার পরও ব্যবসা করছে। এজন্য তাদের বিচারের সম্মুখীন করা দরকার।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সরকার চুক্তি নেই বললেও ফুলবাড়ী নিয়ে কাজ করছে জিসিএম। এখন চায়না পাওয়ার যুক্ত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এখানে কোনো ফাঁকফোকর বা দুই নম্বরি আছে, আর না হলে একটি দেশের সম্পদ নিয়ে চুক্তি ছাড়া কোনো বিদেশি কোম্পানি ব্যবসা করতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘জিসিএম পাওয়ার চায়নার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি উন্নয়ন করতে। আমার মনে হয় না এতে কোনো লাভ হবে। কারণ এখানে ওপেন পিট (উন্মুক্ত খনি) করা যাবে না। অনেক টেকনিক্যাল সমস্যা আছে, যা বিভিন্ন সমীক্ষায় এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে।’
জানা গেছে, পাওয়ার চায়না বাংলাদেশে অন্যতম বিনিয়োগকারী বিদেশি কোম্পানি। বর্তমানে চীনা এই কোম্পানিটি বাংলাদেশের ২৪টি চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে মোট খরচের ৫০ শতাংশ অর্থায়ন করছে। এসব প্রকল্পে মোট ব্যয় ৪ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া এরই মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়া ২০টি প্রকল্পে ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক এসএস পাওয়ার, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণ, এমআরটি লাইন-৬, ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, দাশেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প ও বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি বিএইচপি মিনারেলস দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে কয়লাখনি আবিষ্কার করে। এখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে চেয়েছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জি। ২০০৬ সালে আন্দোলনের মুখে সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে সরকার। এখানে মজুতের পরিমাণ ৫৭ কোটি টন। উত্তোলনযোগ্য মজুত ৪৭ কোটি টন।
ফুলবাড়ী খনি এলাকায় কৃষিজমি ৪১৬২ হেক্টর, বনভূমি ১৯৫ হেক্টর, জলাভূমি ৮১ হেক্টর আর বসতি ৬৬৬ হেক্টর। এতে শস্য উৎপাদন হয় বছরে হেক্টরপ্রতি ধান ৩ থেকে ৪.৫ টন, আলু ২০ থেকে ২৩ টন, গম ৩ থেকে ৩.৫ টন, ভুট্টা ১০ টন আর ডাল প্রায় ১ টন। হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মতে, খনির জন্য ফুলবাড়ীতে একবারে ভূমি লাগবে ২ হাজার হেক্টর। কয়লা তোলার পর খনি এলাকায় পুনর্বাসন করা জমির রূপ হবে কৃষি ২ হাজার ৫৫০ হেক্টর, বনভূমি ১ হাজার ৯৪৬ হেক্টর আর জলাভূমি ৬৯৬ হেক্টর। সংস্থাটির মতে, ফুলবাড়ী খনি এলাকার আয়তন হবে ৫৪.৮ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৪৬ হাজার ৫০০। এদের পুনর্বাসন করতে ১০ থেকে ১২ বছর লাগবে। এই পুনর্বাসনে ব্যয় হবে ১ বিলিয়ন ডলার।