আজকের সারাদেশ প্রতিবেদন:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালেয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন হলুদ দলে বিভক্তির গুঞ্জন দীর্ঘদিনের। এবার খালি মাঠে একাডেমিক কাউন্সিলের ৩ পদে ৬ শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে স্পষ্ট হয়েছে সেই বিভক্তি। শিক্ষক নিয়োগে নিরবচ্ছিন্ন অনিয়মের অভিযোগ বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষরা নির্বাচন বর্জন করায় তিনটি উপদল হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে হলুদ দল। আর তাতেই বিভক্তির গুঞ্জন সত্যি হিসেবে দেখছেন সবাই। চবির একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দুজন করে সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক নির্বাচনকে ঘিরে এই বিভক্তির দেখা দিয়েছে।
আগামী ১৫ অক্টোবর এ নির্বাচনকে সামনে রেখে হলুদ প্যানেলের শিক্ষকরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পৃথকভাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে ৬ পদের বিপরীতে তিন অংশ থেকে প্রার্থী হয়েছেন ১৮ জন শিক্ষক। তবে এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকেরা। দলীয়করণ করে শিক্ষক নিয়োগ চলমান থাকার অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
আওয়ামী শিক্ষকদের সংগঠনের মধ্যে তিন অংশের মধ্যে একটি হচ্ছে মূল হলুদ দল। যদিও এই মূল হলুদ দলকে অবৈধ বলে দাবি করছেন অন্য দুটি প্যানেল। এছাড়া হলুদ দলের প্রশাসনপন্থী শিক্ষকদের একটি প্যানেলের ৬ শিক্ষকও নির্বাচনে অংশ নিতে প্রার্থী হয়েছেন। তবে প্রশাসনপন্থী শিক্ষকদের প্যানেল মানতে নারাজ এই প্যানেলটি। তৃতীয় অংশটি হচ্ছে প্রশাসন থেকে পদত্যাগকারী শিক্ষকদের প্যানেল। এই ৩ অংশই নিজেদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ তথা হলুদ দল বলে দাবি করে আসছেন।
বিভক্তির শুরু:
এদিকে, আওয়ামী লীগ শিক্ষকদের তিন অংশে বিভক্ত হওয়ার মূল কারণ হিসেবে দীর্ঘদিন স্ট্যান্ডিং কমিটির নির্বাচন না হওয়ার বিষয়কে দুষছেন সাধারণ শিক্ষকরা।
জানা গেছে, প্রতি দুই বছর পর সংগঠনটির স্ট্যান্ডিং কমিটির নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও ২০১৭ সালের পর থেকে আর কোনও নির্বাচন হয়নি। এছাড়া বিভিন্ন সময় মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির নির্বাচনের দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন দলটির সদস্যরা। এরমধ্যে গত বছরের ১২ নভেম্বর স্ট্যান্ডিং কমিটির নির্বাচন দেয়ার আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেন ২০১ জন শিক্ষক। এমন কি নির্বাচন না দেওয়ায় চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি হলুদ দলের স্ট্যান্ডিং কমিটি দুই সদস্য পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. শ্যামল রঞ্জন চক্রবর্তী ও আইন বিভাগের অধ্যাপক নির্মল কুমার সাহা পদত্যাগ করেন। তবে সদস্যরা চাইলে নির্বাচনের বিষয়ে আগ্রহী বলে জানান হলুদ দলের আহ্বায়ক মো. সেকান্দর চৌধুরী।
৬ পদে হলুদ দলের ১৮ প্রার্থী:
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দুজন করে সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থী হয়েছেন ১৮ জন। এরা হচ্ছেন সহযোগী অধ্যাপক ক্যাটাগরি নির্বাচনে মূল হলুদ দলের প্যানেল থেকে ওশানোগ্রাফি বিভাগের মো. এনামুল হক ও উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ড. তাপস কুমার ভৌমিককে প্রার্থী করা হয়েছে। প্রশাসনপন্থী হলুদ প্যানেল থেকে ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চের নাসিমা পারভীন ও ফার্মেসি বিভাগের এস এম মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রার্থী করা হয়েছে। এছাড়া প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করা শিক্ষকদের হলুদ প্যানেল থেকে আরবি বিভাগের ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন ও প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ড. রামেন্দু পারিয়ালকে প্রার্থী করা হয়েছে।
যা বলছেন উপনেতার:
সহকারী অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে হলুদ দল থেকে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের আবদুল্লাহ আল মামুন ও নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের তনিমা সুলতানা, প্রশাসনপন্থী শিক্ষকদের পক্ষে থেকে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের উম্মে হাবিবা ও ওশানোগ্রাফি বিভাগের মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম সরকার এবং প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করা শিক্ষকদের পক্ষ থেকে চারুকলা ইনস্টিটিউটের মুহাম্মদ ওবায়দুল কবির ও ফার্মেসি বিভাগের রমিজ আহমেদ সুলতানকে প্রার্থী করা হয়েছে।
প্রভাষক ক্যাটাগরিতে হলুদ দল থেকে লোকপ্রশাসন বিভাগের নওশীন ইসলাম ও বাংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগের হাসনাইন ইস্তেফাজ, প্রশাসনপন্থী শিক্ষকদের পক্ষ থেকে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের জান্নাতুল নাঈম ও ইলেকট্রনিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তাহসিন আহমেদ ফাহিম এবং প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করা শিক্ষকদের পক্ষ থেকে অর্থনীতি বিভাগের কাজী মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ ও ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের শারমিন জামালকে প্রার্থী করা হয়েছে।
প্রশাসনপন্থী শিক্ষকদের প্যানেলের বিষয়ে ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মামুন বলেন, আমরা প্রশাসনপন্থী না। এখানে অনেক শিক্ষক আছেন যারা প্রশাসনের কোনো কাজে জড়িত নয়।
আলাদা প্যানেল দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হলুদ দলের স্ট্যাডিং কমিটির ২ বছর পরপর নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু সে নির্বাচন ৬ বছর ধরে হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় হলুদ দল বিশ্বাসী কিন্তু যারা এখন হলুদ স্ট্যান্ডিং কমিটিতে আছে তারা সে চেতানায় বিশ্বাসী না। কারণ তারা গণতন্ত্রে চর্চা করছেন না। অবৈধভাবে স্ট্যান্ডিং কমিটিতে দখল করে বসে আছেন। আমরা নির্বাচন দিতে বলেছি বারংবার, কিন্তু তারা নির্বাচন দিচ্ছে না। তাই আমরা আলাদা পর্ষদ হয়ে নির্বাচন করছি।
প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করা শিক্ষকদের প্যানেল দেওয়ার বিষয়ে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবুল হোসাইন বলেন, আমাদের পর্ষদের অনেকে প্রশাসনের কোন কাজে জড়িত ছিল না। সুতরাং প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করা শিক্ষকদের অংশ বলাটা আপনার ভুল। তবে আমাদের অনেকেই প্রশাসনের সাথে জড়িত ছিল। কারণ শিক্ষকদের কাজ প্রশাসনকে সহযোগিতা করা। যারা দায়িত্ব পালন করেছে, তারা চেয়ে নেয়নি দায়িত্বটা। সেবা দেওয়ার আমাদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেছে প্রশাসন। আমরাও চেষ্টা করেছি সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে। কিন্তু দীর্ঘ সময়তো আর দায়িত্ব পালন করা যায় না, আমাদের একাডেমিক ও ব্যক্তি জীবন কিংবা বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। সেই ধারণা থেকে আমরা দায়িত্ব ছেড়ে এসেছি।
তিনি বলেন, হলুদ দল দাবি করা অংশটি বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ। বঙ্গবন্ধু যখন স্বায়ত্তশাসন দেয়, তখন গণতন্ত্রই মূল বিষয়। কিন্তু হলুদ দলে সে গণতন্ত্র নেই। তারা স্ট্যান্ডিং কমিটির নির্বাচন দিচ্ছে না গত ছয় বছর। ১৫ জনের কমিটি এখন নেমে এসেছে ৬ জনে। এসব কারণে অবৈধ হলুদ দলের সাথে আমরা নির্বাচনে যাইনি। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী শিক্ষকদের নিয়ে আমরা আলাদা পর্ষদ করেছি। সেই পর্ষদ থেকে অতীতের মতো শিক্ষকদের অধিকার নিয়ে কাজ করব।
মূল হলুদ দলের আহ্বায়ক মো. সেকান্দর চৌধুরী বলেন, হলুদ দল থেকে ৬ জনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। বাকি কারা নির্বাচন করছে, সে বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে দল হইতে হলে সেখনে আহ্বায়ক ও সমন্বয়ক থাকতে হয়। যারা হলুদ বলে নির্বাচন করছে তাদের কি সেগুলো আছে? আমিতো এগুলোকে দল বলবো না।
হলুদ স্ট্যাডিং কমিটির নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, বিধিবদ্ধ অনেক পর্ষদ আছে যেগুলোর নির্বাচন হচ্ছে না। সবার আগে সেগুলো নির্বাচন নিয়ে নিয়ে কথা উচিত। হলুদ দল আর্দশিক সংগঠন, বিধিবদ্ধ কিছু না। তবে সদস্যরা চাইলে আবশ্যই নির্বাচন দেওয়া হবে।
নির্বাচনে নেই বিএনপি-জামায়াত:
অন্যদিকে, নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না বিএনপি ও জামায়াতপন্থী শিক্ষকরা। এ বিষয়ে বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের একাংশে সংগঠন জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর এস এম. নছরুল কদির বলেন, নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে দলীয়ভাবে। তাই নির্বাচনে আমরা অংশ নিচ্ছি না।
নির্বাচন কমিশনার ও রেজিস্ট্রার নূর আহমদ বলেন, ‘আগামি ১৫ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমি কাউন্সিলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে ১৮ জন শিক্ষক মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।’
২ অক্টোবর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ওইদিনই প্রার্থীরা ইচ্ছে করলে তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারবেন। ১৫ অক্টোবর সমাজবিজ্ঞান অনুষদ মিলনায়তনে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন ভোটাররা।’
আজকের সারাদেশ/৩০সেপ্টেম্বর/এএইচ