নিজস্ব প্রতিবেদক:
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। কেউ বা দিয়েছে গাঁ ঢাকা। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কট্টর আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা দেশ না ছাড়লেও গাঁ ঢাকা দিয়ে নতুন রুপে ফিরতে চালাচ্ছেন নানান তৎপরতা। ‘মুক্ত সংলাপ’ আয়োজনের নামে শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার চেষ্টা করছেন তারা; অভিযোগ বেশ কয়েকজন সমন্বয়কের।
এদিকে মুক্ত সংলাপে অতিথি হিসেবে থাকা ৩ জনই আওয়ামী পন্থী পরিচিত মুখ। ইস্ট ডেল্ট ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দর চবির অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুলের ইসলাম এবং আওয়ামী আমলে একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক আবুল মোমেন।
এর মধ্যে ড. মইনুলের ইসলাম সম্পর্কে ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। যেখানে শিক্ষার্থীরা বলছেন অধ্যাপক মঈনুল চবির আওয়ামীপন্থী হলুদ দলের আহ্বায়ক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে কট্টর আওয়ামীপন্থী শিক্ষক হিসেবেও তার পরিচিতি আছে। আওয়ামীপন্থী শিক্ষক হিসেবে হয়েছেন ইউজিসির অধ্যাপকও। এখনো তিনি আওয়ামী মনোনীত সিলেকশন বোর্ডের সদস্য। তিনি শেখ হাসিনা সরকারের নিয়োগকৃত বিআইবিএমের ডিরেক্টর জেনারেলও ছিলেন। এছাড়া হলুদ দলের হয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছিলেন চবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
এমননি অধ্যাপক মঈনুল শেখ হাসিনা সরকারকে পত্রিকার কলাম লিখার মাধ্যমে নিয়মিত ছবকও দিতেন। ২০১১ সালে ২৩ আগস্টে প্রথম আলোতে প্রকাশিত অধ্যাপক মঈনুলে একটি কলামের শিরোনাম ছিলো ‘আওয়ামী লীগ ডুবলে আমরা সবাই ডুবব’।
ড. মইনুল ইসলাম অসম্ভব জেদী, হিংসুটে হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে বিভাগের ভিন্নমতের ছাত্র-ছাত্রীদের হয়রানি করার অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ারও অভিযোগ আছে। ক্ষেত্রবিশেষ তিনি মেধাবী শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষক হতে না পারেন সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্তও করেছেন বলে জানা গেছে।
ড. মইনুল ইসলাম সম্পর্কে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আতিয়ার রহমান এক ফেসবুক পোস্টে লিখেন, মইনুল ইসলাম এতদিন কোথায় ছিলেন? শিক্ষক নিয়োগে উনার দুর্নীতি-দলপ্রীতির বিচার কে করবে? গত ১৬ বছরে প্রথম সারির ছাত্রদের নিয়োগ না দিয়ে তিনি তাদেরকে বঞ্চিত করেছেন। ভাইভা বোর্ডের আগে তিনি এবং তার লোকেরা প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিচয়ের খোঁজ নিতেন। জানি না এসব করে তার, তার দলের, তার ডিপার্টমেন্টের কিংবা তার দেশের কি লাভ হয়েছে। আমার জানামতে তিনি যাদের নিয়োগ না দিয়ে বঞ্চিত করেছেন, তারা কেউ কি বর্তমানে খারাপ জায়গায় আছে?
ড. আতিয়ার রহমান আরও বলেন, তিনি শ্রেণিকক্ষে, তার লেখনিতে ব্যাংক ডাকাতি, অর্থ পাচার নিয়ে কথা বলতেন কিন্তু গত ১৬ বছরে এইগুলা নিয়ে তিনি তেমন কিছু বলেন নাই। তার পত্রিকার বেশিরভাগ লিখা বিএনপি-জামায়াত দিয়ে শেষ হতো, যেটা বেশিরভাগ সময়ে কোনোভাবেই টপিকের সাথে সামঞ্জস্য ছিল না। পরিশেষে বলছি, যে শিক্ষক নিজের মতাদর্শের জন্য নিজের ডিপার্টমেন্ট বা দেশকে বিক্রি করে দিতে পারেন, তাকে আমি ঘৃণা করি।
এদিকে ফেইসবুক লাইভে আওয়ামী পন্থী শিক্ষকদের আয়োজিত এই মুক্ত সংলাপ বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, একটা বিষয় আপনাদের জানিয়ে রাখার জন্যই মূলত লাইভে আসা। সেটা হচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে এ নিয়ে একটা মুক্ত সংলাপের কর্মসূচী আহ্বান করা হয়েছে, যারা এটি করেছেন তারা হচ্ছে আওয়ামী লীগের দালাল। আমরা অবশ্যই চাই মুক্ত সংলাপ হোক। বিশ্ববিদ্যালয় কেমন হবে, শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে, আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে- এ নিয়ে সেমিনার হোক এবং সেখানে শিক্ষার্থী, সকল পেশাজীবি, শিক্ষকসহ সকলের অংশগ্রহণ থাকুক। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আওয়ামী লীগের দোসর শিক্ষক নগরীর কাজির দেউড়িতে একটা মুক্ত সংলাপের আহ্বান করেছে।
তিনি আরও বলেন, কাজির দেউড়ির আশপাশেই যেখানে গতকাল একটা সাম্প্রদায়িক সংঘাত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। ঠিক সেই জায়গায় আওয়ামী একজন শিক্ষক মুক্ত সংলাপের আহ্বান করেছে। আমাদের আজকের বাংলাদেশে যেখানে আমরা স্বাধীনভাবে আমাদের সকলের মতামত প্রকাশ করতে পারছি, আমাদের চিন্তাধারা প্রকাশ করতে পারছি এবং আমরা সবাই মিলে আমাদের আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে সেসব নিয়ে আলোচনা করতে পারছি।
যারা এ আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে ছিল, নেতৃত্বে ছিল তাদেরকে না জানিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে না জানিয়ে এরকম একটি সংলাপ আমরা আশা করতে পারি না। যিনি এটা করেছেন তিনি হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগের হলুদ দলের আহ্বায়ক ছিলেন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন, সেক্রেটারি ছিলেন এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা কর্তৃক নিয়োগকৃত বিআইবিডিএমের ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন। এখন পর্যন্ত আওয়ামী মনোনীত সিলেকশন বোর্ডের সদস্য আছেন, আওয়ামী মনোনীত ইউজিসি অধ্যাপক। আওয়ামী, জেদি, হিংসুটে মইনুল বিভাগের শিক্ষার্থীদের হয়রানি করতেন, ভিন্ন মতের শিক্ষকদের হয়রানি করতেন। আওয়ামী সরকারের পক্ষে পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখে সবক দিতেন। অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আস্থাভাজন একজন শিক্ষক যিনি কি-না মুক্ত সংলাপের আহ্বান করেছেন।
আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশেই আহ্বানটা করেছেন। যে ২য় স্বাধীনতার নেতৃত্বে ছিল শিক্ষার্থীরা তাদেরকে এই সংলাপের বিষয়ে জানানো হয়নি। এছাড়াও আমাদের চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যে গ্রুপগুলো সেখানেও তিনি সেটা পোস্ট করেননি। গোপনে একটা মুক্ত সংলাপের আহ্বান করেছেন। সেটা কার সাথে হচ্ছে? কীভাবে হচ্ছে? কেন হচ্ছে? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যারা ধ্বংস করেছেন তারাই আবার কি-না শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে সেটার আউটলাইন, রুটম্যাপ তৈরি করতে চাচ্ছেন। মতামত প্রকাশ করতে চাচ্ছেন।
আমরা সকলের মতামতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছি, আমাদের সরকার করছে। কিন্তু যারা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে তারাই যদি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আবার আলোচনা করতে চায়, শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে তা নিয়ে সংলাপ করতে চায় সেটা হচ্ছে একধরনের নিজেদের সাথেই স্ববিরোধীতা। আমরা এই মুক্ত সংলাপকে প্রত্যাখ্যান করছি এবং যারা গোপনে আওয়ামী লীগের দোসর হয়ে কাজ করতে চাচ্ছেন তাদেরকে হুঁশিয়ার করে জানিয়ে দিতে চাই- আপনারা আওয়ামী লীগের দোসর হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবেন না। আপনারা সাবধান হয়ে যান। এই মুক্ত সংলাপকে আমরা প্রত্যাখ্যান করলাম।