আজকের সারাদেশ প্রতিবেদন
চট্টগ্রামের জেএমসেন হলের পূজা মণ্ডপে যে ‘ইসলামিক গান’ গাওয়া নিয়ে তোলপাড় চলছে সেই গানটির গীতিকার মোহাম্মদ আবদুল হালিম চৌধুরী অবশেষে মুখ খুললেন। চট্টগ্রাম বন্দর কলেজের প্রাক্তন এই অধ্যক্ষ গানটি নিয়ে বিস্তারিত লেখেছেন নিজের ফেসবুকে। শুক্রবার (১১ অক্টোবর) রাত ৮টা ৩৯ মিনিটে তার দেওয়া স্ট্যাটাসটি বহু মানুষ শেয়ার করেছেন।
মোহাম্মদ আবদুল হালিম চৌধুরী লেখেন, ‘১৯৯৩ সালে কক্সবাজারের চকরিয়া কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক থাকার সময় আমি গানটা লিখি। মূলত ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ফলে সমগ্র ভারত উপমহাদেশে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এই দাঙ্গায় প্রায় তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারান। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ঐতিহাসিক প্যারেড ময়দানে তাফসিরুল কোরআন মাহফিলে দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী দর্শক-শ্রোতাদের কোরআন-হাদীসের রেফারেন্স দিয়ে বুঝিয়ে দেন- ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা এবং মুসলিম হত্যার জন্য এদেশের নিরপরাধ হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করা ইসলাম সমর্থন করে না বরং এটি হবে গর্হিত কাজ। এটি সরকারিভাবে, কুটনৈতিকভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। তার এইসব যুক্তিপূর্ণ কথা এবং আমার নিজের অধ্যয়ন থেকে ১৯৯৩ সালে গানটি লেখা ও সুরারোপ করা হয়। গানটি সে সময়ে মুসলিম তরুণ-কিশোর-যুবাদের মাঝে অমুসলিমদের বিষয়ে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিল। গানটি সে,সময়ে বেশি বেশি গাওয়া হতো। পরে জেনেছি-গানটি বাংলাদেশের তুলনায় ইংল্যান্ড ও আমেরিকাতে বেশি গাওয়া হয়েছে।’
মোহাম্মদ আবদুল হালিম দাবি করেন, গানটি প্রচলিত অর্থের ইসলামী গান নয়। তিনি বলেন, ‘এটি আন্তঃধর্মের সম্প্রীতির গান। এই দিক থেকে এটি চমৎকার একটি দেশাত্ববোধক গান। কারন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ দেশপ্রেম।এই গানে স্থায়ী ছাড়া তিনটি অন্তরা রয়েছে। স্থায়ীতে ইসলাম যে সর্বজনীন ধর্ম সে বিষয়ে। প্রথম অন্তরায় ইসলামি রাস্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার বিষয়ে, দ্বিতীয় অন্তরায় অমুসলিমদের প্রতি কোন মুসলিমের অবিচারের শাস্তি বিষয়ে এবং
তৃতীয় অন্তরায় মানব ধর্ম হিসাবে ইসলাম ধর্ম অধ্যয়ন করে অন্যান্য ধর্মের অধিকার বিষয়ে জানার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।’
পূজা মন্ডপে আমন্ত্রণ পেয়ে গানটি নির্বাচন করে সংশ্লিষ্টরা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেও তৃতীয় অন্তরা গেয়ে নির্বুদ্ধিতা দেখিয়েছে বলে জানান আবদুল হালিম চৌধুরী। সেটি স্পষ্ট করে তিনি লেখেন, ‘স্থায়ী, ১ম, ২য় অন্তরা সব ধর্মের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গাওয়ার উপযোগী। ৩য় অন্তরা বিশেষ করে মুসলিম সমাজের উদ্দেশ্যে করা। পূজা মন্ডপে আমন্ত্রণ পেয়ে গানটি নির্বাচন করে সংশ্লিষ্টরা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। তবে গাওয়ার সময় ৩য় অন্তরা গাওয়াটা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে। গানের লিরিক পড়ে কোন পরিবেশের জন্য কোন কথা উপযোগী এতটুকু জাজ করার ক্ষমতা না থাকলে পাবলিক প্লেসে বা ভিন্ন ধর্মের পরিবেশে গান গাওয়া উচিত নয়।’
তবে তৃতীয় অন্তরায় হিন্দু ধর্মকে আঘাত করে কিছু নেই বলেও জানান আবদুল হালিম চৌধুরী। তিনি লেখেন, ‘এখানে (৩য় অন্তরা):হিন্দু ধর্মকে আঘাত করে কোন শব্দই নেই, কেবল ইসলাম ধর্মের পজিটিভ দিক তুলে ধরা হয়েছে।’
আবদুল হালিম চৌধুরী দাবি করেন, ‘পরবর্তীতে বিদ্বেষমূলকভাবে গানটির প্রথমাংশ বাদ দিয়ে শেষ অন্তরাকে হাইলাইট করে কিছু মিথ্যা তথ্য দিয়ে (একটা ছাত্র সংগঠনের নাম ব্যবহার করা, জোর করে স্টেজে উঠা, ইসলামি গান করা ইত্যাদি) সাকলাইন মোর্শেদ নামে একজন ফেসবুকে পোস্ট দেন। স্বাভাবিকভাবে হিন্দু ভাইবোনের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে।পোস্টটি দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। শুরু হয় পক্ষে- বিপক্ষে নানান কথা ছড়িয়ে পড়ে।’
আবদুল হালিম পরে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে
যারা আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তারা আন্তরিকতার সঙ্গেই কাজটি করেছেন সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বাড়ানোর লক্ষে। কারন ঐ শিল্পীরা ইতিপূর্বে মন্ডপ পাহারা দিয়েছিল বলে জেনেছি। যারা গান গেয়েছে তারা আন্তরিকতার সাথেই গেয়েছে। তবে ঐ ধর্মীয় পরিবেশে ৩য় অন্তরাটা গেয়ে তারা কূপমন্ডুকতার পরিচয় দিয়েছে।’
আবদুল হালিম তাৎক্ষণিকভাবে সুন্দর করে শেষ হওয়া বিষয়টি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মিথ্যা তথ্য ও কাটসাট ভিডিও পোস্ট করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টাকারী সাকলাইন মোর্শেদকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। পাশাপাশি পরবর্তীতে গানের ৩য় অন্তরা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনেকের মনোঘাতের কারন হওয়ায় শিল্পীদের দু:খ প্রকাশ করে ক্ষমা চাওয়া উচিত বলেও জানান।
আবদুল হালিম আরও লেখেন, ‘আমি মনে করি- প্রত্যেক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নিজস্ব মেজাজ ও বৈশিষ্ট্য আছে। সে মেজাজ ও বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশ বজায় রেখে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো সম্পন্ন করা উচিত। এই দিক থেকে আমন্ত্রণ পেলেও শিল্পীরা গান না গেয়ে শুধু পাহারায় থাকলে ভালো হতো। ইফতার মাহফিলে কোন হিন্দু ভাই কীর্তন বা শ্যামা সঙ্গীত গাইলে রোজাদারদের কেমন লাগবে? পূজা কমিটির পক্ষ থেকে গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ দেওয়া উচিত হয়নি। পুলিশ প্রশাসনকে আহবান করবো এখন কোন রাজনৈতিক চাপ নেই। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে দ্রুত তদন্ত করে সঠিক তথ্য জাতির সামনে উপস্থাপন করুন- ঐ গান গাওয়ার পিছনে কোন খারাপ উদ্দেশ্যে ছিল কিনা।’