আজকের সারাদেশ প্রতিবেদন
গুদামের একটি রুম মেরামতে ব্যয় হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। অথচ এর চেয়ে অনেক কম খরচে একই ধরনের নতুন কক্ষ নির্মাণ করা যেত। এভাবে এলইডি বাতি, ওয়াকিটকিসহ বেশ কিছু যন্ত্রপাতি কেনা হয় বাজারদর থেকে ৮ থেকে ১৫ গুণ বেশি দামে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর সিআরবিতে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানে এসব চিত্র উঠে এসেছে।
শুধুই কি কেনাকাটা! সরকারি জমি দখল থেকে শুরু করে অবৈধ ব্যাটারি রিকশা চার্জিং কারবার কিংবা স্টাফদের বাসা বরাদ্দে অনিয়ম, টিকিট কালোবাজারি, টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) অভ্যন্তরে র্যাঙ্ক বাণিজ্য, অবৈধ পদোন্নতিসহ নানা অনিয়মে জর্জরিত রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব আবদুল বাকীর প্রথম সফর ঘিরে এখন আতঙ্কে- অনিয়মে জর্জরিত রেলওয়ের কর্মকর্তারা।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের টানা শাসনকালে মূলত রেলওয়ের প্রকৌশল, বাণিজ্যিক, টেলিযোগাযোগ ও সংকেত, মেকানিক্যাল, ইলেকট্রনিক, ভূ-সম্পত্তি বিভাগে অনিয়ম-দুর্নীতিতে গড়ে ওঠে শক্তিশালী চক্র। একইভাবে রেলওয়ে সম্পদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আরএনবিও যোগ দেয় দুর্নীতির মহোৎসবে। বিভিন্ন স্থাপনা ও সম্পদ রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব, তারাই হয়ে ওঠেন ভক্ষক। পদে পদে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট ঘিরেই উঠে আসে অনিয়মের অভিযোগ। এদের মধ্যে ঠিকাদার থেকে শুরু করে রেলওয়ে কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে শক্তিশালী চক্রের হাত ধরেই এসব অনিয়ম চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যেখানে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বিভিন্ন ঠিকাদার সক্রিয়। বিভিন্ন সময় আলোচনা-সমালোচনায় উঠে এসেছে রেলওয়ের আলোচিত ঠিকাদার রতন কাউছার, নওফেল ও সিসিএম দপ্তরের শহীদের নাম। রেলওয়ের বিভিন্ন ঠিকাদার ও কর্মকর্তারা আগে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন অনিয়মে জড়িত থাকলেও প্রেক্ষাপট বদলের পর তারা ধরনা দিচ্ছেন বিএনপি নেতাদের কাছে। শ্রমিক লীগের অনেক নেতার হদিস নেই। তবে রেলের সম্পত্তি দখলে নিতে শ্রমিক দল ও জামায়াতের নাম ভাঙিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন অনেকেই। আবার টেন্ডার বাণিজ্যেও পুরোনোদের পাশাপাশি নতুন নতুন মুখ আসছে। কেউ কেউ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকার পতনের পর অনেকেই আসছেন নতুন দলীয় পরিচয় নিয়ে। অথচ এর আগে তারাই আওয়ামী লীগের পরিচয় দিতেন।’
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ে সচিব আব্দুল বাকী ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম সফরে আসবেন। তিন দিনের সফরে কক্সবাজার রেলপথের বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করবেন তিনি। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অনিয়ম ও রেলওয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভিন্ন কার্যক্রম বিষয়ে আলোচনা করবেন। তাছাড়া দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। সেই তালিকা অনুযায়ী সহসাই কঠোর অ্যাকশনে যাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ে মহাপরিচালক সরদার শাহাদাত আলী বলেন, ‘রেলওয়ের দুর্নীতি- অনিয়ম বন্ধে আমরা সবসময় জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছি। দুর্নীতি ও অনিয়মে যে-ই জড়িত থাকুক, ছাড় দেওয়া হবে না। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত পূর্বক আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এর আগে চলতি বছরের শুরুতে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মালিকানাধীন জমি থেকে দখলদার হটানোর উদ্যোগ নেয় রেল কর্তৃপক্ষ। তবে নানা কারণে উচ্ছেদ অভিযান থমকে যায়। তা ছাড়া চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, খুলশী, ওয়্যারলেস এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে রেলওয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে অবৈধ বাণিজ্য। রেলওয়ের জমি-বাসায় গড়ে তোলা এসব গ্যারেজ থেকে খোদ রেলওয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের স্টাফরা মাসোহারা তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
একইভাবে নানা অনিয়মে জর্জরিত রেলওয়ের বাণিজ্যিক বিভাগ। প্রতিটি স্টেশনে স্থাপিত ডাস্টবিনে পলিথিন সরবরাহ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও কোনো স্টেশনেই সরবরাহ করা হয় না। অথচ
জানা গেছে, নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে অনেকের নাম সামনে আসছে। এর মধ্যে পূর্ব রেলের সাবেক প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করছেন। র্যাঙ্ক বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগে পূর্ব রেল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে বদলি করা হয় আরএনবি প্রধান জহিরুল ইসলামকে। আরএনবির এ শীর্ষ কর্মকর্তার অনিয়মের তদন্ত না হওয়া এবং জহিরুলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ রেলওয়ে স্টাফরা। যদিও জহিরুল ইসলামের অনিয়মের তদন্তে মাঠে নেমেছে দুদক।
অন্যদিকে বাণিজ্যিক বিভাগে ১৫ বছর ধরে ঠিকাদারি কাজ পরিচালনা করছে শাহ আমানত ট্রেডিং, জান্নাত ট্রেডিং ও সামির এন্টারপ্রাইজ। নামে-বেনামে এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় আছেন শহীদ নামে একজন ঠিকাদার, যেখানে নিজের স্ত্রী ও ছেলের নামেও ঠিকাদারি লাইসেন্স বানিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের নামে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন তিনি। মামুনের হাবীব বাণিজ্য বিতান, অলির ওয়াহিদা সার্ভির্সেস/ ক্লিন সার্ভিস, ইঞ্জিনিয়ার বিভাগে রয়েছে ম্যাক্স, তমা, প্রগতি, নূরে এলাহি, কেশল কনস্ট্রাকশনসহ আরও বেশ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বীরদর্পে ১৫ বছর ধরে কাজ করে আসছিল। তবে সরকার পতনের পর এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেই গা-ঢাকা দিয়েছেন। আত্মগোপনে থাকায় অনেকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া টেলিযোগাযোগ বিভাগের পূর্বাঞ্চলে প্রধান দায়িত্বশীল সুশীল হাওলাদারের ছাত্রছায়ায় বেশ কয়েকজন ঠিকাদার পার্সেন্টিজে যুক্ত হয়ে নামে-বেনামে কাজ করছেন। সুশীল হাওলাদার দীর্ঘদিন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে নানা সুবিধা ভোগ করে ভোল পাল্টে নতুন সরকারের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছেন। একই চিত্র বিভিন্ন দপ্তরেও দেখা গেছে।