অধ্যাপক মোহীত উল আলম
কয়েকদিন আগে রবিউল ইসলাম নামক এক তরুণ চাকরি-প্রত্যাশী নাটোর থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলেন পদ্মা মেইলে করে। মেইলটি টঙ্গী স্টেশন ছাড়ার পর অতর্কিতে ছুটে আসা একটা পাথরের ঘায়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পাথরটি তীব্র বেগে তাঁর ডান চোখে আঘাত করে, এবং তিনি আর চোখে দেখতে পান না। গণমাধ্যমে তাঁর অসহায় ছবি ছাপা হয়েছে। তিনি হয়ত চিরতরে তাঁর ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি হারালেন। এবং তাঁর চাকরিতে হাজির হবার আর প্রশ্নই উঠলো না।
এই ঘটনার তেত্রিশ বছর আগে ১৯৯০ সালে আমার আপন এক ভাগ্নে ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য ও নগর নক্শা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্মান ডিগ্রি পাশ করে ঢাকার একটি নাম করা স্থাপত্য দপ্তরে চাকরিতে যোগ দেবার পর বিয়ে করার অভিলাষে চট্টগ্রামে আসতে মহানগর গোধূলীতে চাপে। তার জন্য আমার দুলাভাই মেয়ে দেখার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। কিন্তু ট্রেনটি ব্রাম্মণবাড়িয়া স্টেশন পার হয়ে গেলে হঠাৎ ছোঁড়া একটা পাথর তীব্র বেগে তার থুৎনিতে এসে লাগে। থুৎনি ফেটে যায়, রক্তপাত শুরু হয়। ভাগ্যিশ ট্রেনে একজন ডাক্তার ছিলেন। তিনি থুৎনি সেলাই করে সেখানে পুরু ব্যান্ডেজ দিয়ে দেন। চট্টগ্রামে এসে ভাগ্নে পরের দিন ব্যান্ডেজ পরা অবস্থায় মেয়ে দেখতে গেলে ভাগ্নে পাশ করে না। রবিউল যেমন তাঁর চোখসহ চাকরি হারালেন আমার ভাগ্নে হারালো তার সম্ভাব্য স্ত্রীকে। সে ভাগ্নে অবশ্য সপরিবারে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে স্থায়ীভাবে অবস্থান করছে বহুদিন হলো।
এর নয় বছর পর, অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে, আমি নিজেও এরকম একটা ঘটনার সম্মুখীন হয়ে প্রায় আমার পিএইচডি ডিগ্রি হারাতে বসেছিলাম। আমার থিসিস ডিফেন্সের তারিখ পড়েছিল ১০ অক্টোবর। অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার ছিলেন আমার তত্ত্বাবধায়ক। ঢাবির কলাভবনে তাঁর দাপ্তরিক কক্ষেই আমার সাক্ষাৎকার। সে হিসেবে আমি ৯ অক্টোবর রাতে ঢাকা মেইলের একটি প্রথম শ্রেণি কক্ষে স্লিপিং বার্থ রিজার্ভ করি। এসি ছিল কি ছিল না মনে করতে পারছি না। ট্রেনটি ঠিক সাড়ে দশটায় ছাড়লো। আমার ক্যুপে আরেকজন যাত্রী ছিলেন, তিনি কোন বাক্য বিনিময় না করে ওপরের বার্থে হনুমানের মতো লাফ দিয়ে উঠে নাকেমুখে কম্বল দিয়ে শুয়ে পড়লেন। ট্রেন গতি পেতে পেতে পাহাড়তলী পার হয়ে গেল। আমি তার পরের দিনের ভাইভাতে কী ধরনের জেরার মুখোমুখি হতে পারি তার একটা রিহার্সাল দিচ্ছিলাম। এমন সময় দেখি ট্রেন থেমে গেছে, বাইরে বিরাট কিসের যেন হট্টগোল । আর হঠাৎ দেখি কাচের জানলা ভেদ করে, জালির আবরণ ফেটে আমার বাঁ কাঁধের গোড়ায় কী যেন একটা স্পর্শ করল, আর আমার হাত গড়িয়ে আস্তে করে সিটে পড়ল। কী ব্যাপার! হাতে নিয়ে দেখলাম, রেলের স্লিপারের নীচে গোঁজা থাকে সেরকম কালো রঙের প্রায় আধা কেজি ওজনের বিরাট একটা শিল পাথর। আমি ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে সিট ছেড়ে ভিতরের দরজার আড়ালে দাঁড়ালাম। এইরকম মিনিট দশেক গোলমাল চলল, ট্রেনটাকে লক্ষ করে পাথর আর ঢিল ছোঁড়া হতে লাগল। তারপর এক সময় সব থেমে গেলে ট্রেনটি আবার চলা শুরু করল। সকালে কমলাপুর স্টেশন পৌঁছালে আমি পাথরটা হাতে নিয়ে স্টেশন মাস্টারের কামরায় গেলাম নালিশ ঠুকতে। তিনি ব্যাপারটা এর মধ্যে জেনেছেন। আমি ট্রেনে যাত্রীর নিরাপত্তা বিধান রেলওয়ের অন্যতম দায়িত্বের কথা বললে, তিনি পাল্টা যুক্তি দিলেন, নিরাপত্তা না থাকলে না থাকলো, তাই বলে পাথর মারতে হবে নাকি? তাঁর যুক্তিটা বুঝলেও আমি শান্ত হলাম না। একটা রিকশা নিয়ে গেলাম হাটখোলা রোডের ইত্তেফাক অফিসে। কিন্তু দেখলাম অত সকালবেলা সংবাদ নিতে পারে সেরকম কোন সাংবাদিক উপস্থিত নেই। তখন চবির ঢাকাস্থ গেইস্ট হাউজ ছিল ধানমন্ডি ৯এর এ—তে। আমি সেখানে আমার ব্যাগ রেখে, অন্যান্য ফর্মালিটি সেরে ভাইভাতে উপস্থিত হলাম। কিন্তু এই ঘটনার কথা বললাম না, যে পাথরটা যদি জানলার শার্সি আর জালির কারণে গতিপথ না হারাতো তা হলে ভাইভাতে বসার আগেই তাঁরা আমার অন্য খবর পেতেন। বললাম না, এই ভেবে যে আবার স্যারেরা যদি মনে করেন যে আমি উটকো প্রসঙ্গ টেনে তাঁদের মন নরম করতে চাইছি। ঘন্টাখানেক মোটামুটি একটা টিট-ফর-ট্যাট জাতীয় জমজমাট সাক্ষাৎকার হলো, এবং রেওয়াজ অনুযায়ী সিরাজ স্যার আর শিরীন ম্যাডাম আমাকে অভিনন্দন জানালেন। কবীর স্যার তাঁর প্রশংসাবাণী লিখিত আকারেই জমা দিয়েছিলেন। ‘আমি কী হনুরে’ একটা ভাব নিয়ে রূমে ফিরলাম। তখন নাজনীন সুলতানা পল্লবী নামে আমার এক প্রাক্তণ ছাত্রী আর তাঁর নৌবাহিনীতে চাকুরীরত স্বামী আমাকে বিকালে তাঁদের বাসায় নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি নিয়ে এলেন। তাঁদেরকে পাথরটা দেখালাম। ধানমন্ডি ৩ এর এ-তে তখন ডেইলি স্টারের অফিস ছিল। আমরা ক্যাপ্টেইনের জিপে করে ডেইলি স্টারে নামলাম। তাঁরা সাগ্রহে আমার ঘটনাটা শুনলেন, এবং পাথরটি আলামত হিসেবে রেখে দিলেন। তারপরের দিন আমি চট্টগ্রামের দিকে ফেরার পথে ডেইলি স্টারে দেখলাম খবরটি সবিস্তারে ছাপা হয়েছে। পত্রিকার মারফৎ জানলাম যে ফৌজদারহাট স্টেশনে কিছ টিকেটধারী যাত্রীকে না উঠিয়েই ট্রেনটি ছেড়ে যাচ্ছিলো বলে ক্ষিপ্ত হয়ে যাত্রীরা ট্রেনটিকে লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়ে।
এই পাথর ছোঁড়ার সঙ্গে ঈশপের সেই “ব্যাঙ আর বালকদের” গল্পটার কথা নিশ্চয় এই লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের মনে পড়ছে যে “তোমাদের জন্য যাহা ক্রীড়া, সেটা আমাদের জন্য মরণ” –ব্যাঙদের শিরোমণির এই কথাটা ।
রবিউল চোখ হারিয়েছেন, আমার ভাগ্নে হারিয়েছে তার সম্ভাব্য স্ত্রী, আমার উপক্রম হয়েছিল জীবন অথবা নিদেনপক্ষে পিএইচডি ডিগ্রি হারাবার আশংকা। কিন্তু এটার প্রতিকার কী?
একটা ঘটনার কথা বলি। তখন চবিতে ইসলামী ছাত্র শিবিরের উৎপাতে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। হরহামেশা খুন জখম ক্যাম্পাসে লেগেই ছিল। তখন এক পর্যায়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ (বর্তমানে আইআইইউসির মাননীয় উপাচার্য), এবং আমি ছিলাম কার্যকরী পরিষদের একজন নির্বাচিত সদস্য। তখন বাংলাদেশের সড়কমন্ত্রী ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ওলী আহমেদ। তিনি মন্ত্রণালয়ের কাজে এসে সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলেন। যেহেতু চট্টগ্রামের লোক, আমরা শিক্ষক সমিতি থেকে ঠিক করলাম তাঁকে শিবিরের ক্যাম্পাসে এই অনাচার নিয়ে অভিযোগ জানাব। তিনি আমাদেরকে সাক্ষাৎ দিলেন এবং এক পর্যায়ে বললেন যে যদিও সরকার সকল শিক্ষাঙ্গণে শান্তি চান, কিন্তু সরকারের পক্ষে সম্ভব নয় যে (ইংরেজিতে বললেন) “টু পুট আ পুলিসম্যান বিহাইন্ড এভরি পারসন।”
এই কথাটা দারুণ সত্য। কোন সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না যে স্বামী দ্বারা স্ত্রী হত্যা রোধ করা, ব্যাংক থেকে টাকা চুরি করা রোধ করা, টাকা পাচার করা, বেপরোয়া গাড়ি চালককে বাধা দেওয়া, কিংবা চলন্ত ট্রেনে দুরন্ত শিশুর পাথর নিক্ষেপ করা। কারণ পুলিশতো সব জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে না।
এইখানে এই ধরনের সামাজিক এবং রাষ্ট্রীক অপরাধের প্রতিবিধান বা প্রতিকারের উপায় হলো নিরবচ্ছিন্ন সুশাসন। অষুধের ক্ষেত্রে যেমন বলা হয় যে “প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর” প্রতিকারের চেয়ে প্রতিবিধান ভালো, তেমনি সামাজিক ও রাষ্ট্রীক অপরাধের ক্ষেত্রে প্রতিবিধান হচ্ছে প্রতিকারের চেয়ে ভালো।
এই প্রতিবিধান আসতে হবে সুশাসনের পথে। এবং সুশানের একটি অন্যতম স্তম্ভ হলো সুশিক্ষা। সুশিক্ষার মূল মন্ত্র হলো বিবেককে জাগানো। সুশিক্ষার মাধ্যমে ঈশপের এই শিক্ষা শুধু বইয়ে নয় বাস্তব জীবনে জনগণের মধ্যে সতত চেতনার অংশ হতে হবে যে সুশিক্ষা হলো দেশ প্রেমের শিক্ষা। দেশ প্রেম হলো নিজেকে ভালোবাসা এবং সাথে সাথে অন্যকে ভালোবাসার শিক্ষা। কিন্তু দু:খের বিষয়, সুশিক্ষার নামে আমরা আত্মনং বৃদ্ধি ও নিজের স্বার্থের বাইরে কিছুই শিখি না। সুশিক্ষা হলো রাজনীতিরে নামে দেশকে দুই ভাগ করা নয়, সুশিক্ষা হলো এক রাষ্ট্রে বহু মতাদর্শের সহাবস্থান।
একজন দুবৃত্তপরায়ন বিবেকহীন কিশোরের চলন্ত ট্রেনের পতি পাথর ছোঁড়ার মধ্যে যে অমানবিকতা, অবিমৃশ্যকারিতা, অপরিণামদর্শিতা ও বিবেকহীনতা আছে তার সঙ্গে জটিলভাবে সম্পর্কিত চোরাচালানীদের অপরাধ, জায়গাবেদখলকারী, নদীদখলকারী, ভেজাল অষুধ ও ভেজাল খাদ্যের ব্যবসায়ীরা, বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির, কিংবা গরিবের হক-মারার নিষ্ঠুর ইতিহাস। সামাজিক আচরণে কোনটার সঙ্গে কোনটার বিচ্ছিন্নতা নেই।
দেশতো সবার, দায়িত্ববোধও সবার। টঙ্গী অঞ্চলে যে জায়গায় রবিউলকে চোখ হারাতে হলো সে জায়গায় পুলিশ গিয়ে একে একে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করুক। অপরাধী পাগল হোক, কিংবা স্বাভাবিক হোক, কিংবা শয়তান হোক তাকে ধরতেই হবে। হোক এটা পুলিশের জন্য একটি এসিড টেস্ট।
লেখক:
কবি, কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও অনুবাদক